Mahabharat Through Doctor's Eye | মহাভারত এবং কুরুবংশ - সিদ্ধান্ত এবং স্বীকারোক্তি - লিখেছেন -ডাঃ ইন্দ্রনীল আইচ


Mahabharat Through Doctor's Eyes


মহাভারত এবং কুরুবংশ   - প্রশ্ন পর্ব: ডাঃ ইন্দ্রনীল আইচ


আমার গুরু...প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বারংবার আমাকে বলেন,  "ইন্দ্রনীল...তুই ডাক্তার বলে ডাক্তারী সংক্রান্ত জিনিস চটপট বুঝে যাবি...কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাকি সবাই সেটা অতো তাড়াতাড়ি বুঝবেন। পাঠক...লেখকের সবকিছু। পাঠক লেখার সাবজেক্ট না বুঝলে গোটা লেখাটাই মাটি হয়ে যাবে। সুতরাং এইসব ক্রিটিক্যাল ব্যাপার নিয়ে লেখার সময় 'ধীরে চল' নীতি নিবি"। গুরুবাক্য বেদবাক্য। সুতরাং সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে মহাভারতের একটি বিশেষ জায়গা আমি রিক্যাপ করবো এবং কিছু প্রশ্নের অবতারণা করবো। আপনারা দয়া করে একটু ধৈর্য্য ধরুন।


শান্ত্বনু এবং সত্যবতীর বিয়ের পরে তাঁদের দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রথমজন চিত্রাঙ্গদ...যিনি অত্যন্ত কম বয়সে চিত্রাঙ্গদ নামেরই একজন গন্ধর্বের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত হন। অপরজন বিচিত্রবীর্য...যিনি অসাধারণ রূপবান ছিলেন, সারা জীবনে একটাও যুদ্ধ করেননি, অম্বিকা এবং অম্বালিকা নামক দুই সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্যে বছরসাতেক দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করবার পরে অকালে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। অন্তত ব্যাসদেব রচিত মহাভারত সেই কথাই বলে।

উত্তরাধিকার সংকটে পড়ে যায় কুরু রাজসিংহাসন। আসরে নামেন সত্যবতী। ডেকে আনেন ব্যাসদেবকে। বলেন, "বাছা...আমার কুরু রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী চাই। তোমার ভাইরা মৃত...তুমিই আমার শেষ ভরসা। তোমাকে নিয়োগ করলাম আমি, নিজের ঔরসে তোমার ভাইয়ের স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান আনো।"

অদ্ভুত ছিলো এই নিয়োগ প্রথা। প্রস্তুত করা হলো অম্বিকাকে। দুর্গন্ধযুক্ত প্রলেপ মাখানো হলো তাঁর সারা শরীরে...আপাদমস্তক ঢেকে দেওয়া হলো কাপড় দিয়ে...কেবলমাত্র যোনিপথ রইলো উন্মুক্ত। কেন এই ব্যবস্থা? ব্যাস কিংবা অম্বিকা...কারও মনেই যাতে কামভাব না জাগে...স্পার্ম ডোনেট করতে এসেছ...করো...ফিরে যাও...মুখ দেখবার দরকার নেই...আদর সোহাগের প্রশ্নই আসে না।

অম্বিকার ঘরে ঢুকলেন ব্যাস। ভয়ে কাঁপছেন অম্বিকা...কাপড়ের একদিকটা তুলে দেখতে গেলেন যে ঘরে কে ঢুকেছে। চমকে উঠলেন! জটাজুটধারী সাধু, মেঘের মতো কালো, ভয়ংকর তেজ...ভয়ে চোখ বন্ধ করলেন অম্বিকা। কাজ শেষ করে বেরিয়ে এলেন ব্যাস...গম্ভীর মুখে সত্যবতীকে বললেন, "চোখ বন্ধ করে ফেলেছে মা...ছেলে হবে...তবে জন্মান্ধ!"

হতাশ হয়ে পড়লেন সত্যবতী। অন্ধ ছেলে রাজা হবে কি করে? অতএব প্রস্তুত করা হলো অম্বালিকাকে। তাঁকে পাখি পড়া করে শেখালেন সত্যবতী…"চোখ যেন বন্ধ না হয়"। রাতে অম্বালিকার ঘরে ঢুকলেন ব্যাস। ব্যাসের ভয়ংকর চেহারার সামনে আতংকিত হয়ে পড়লেও চোখ খোলা রাখলেন তিনি...শ্বাশুড়ীর আদেশ...কিন্তু ভয়ে একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যাস সত্যবতীকে বললেন, "এবারেও ছেলে হবে...তবে সে হবে অসুস্থ...রক্তশূন্য!"

বর্তমানে ইনফার্টিলিটির একটি অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি "আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন" এর সঙ্গে এই নিয়োগ প্রথার মিল আছে কি নেই সেটা অন্য প্রশ্ন...অন্য কোনদিন তা নিয়ে আলোচনা করবো। আপাতত পাণ্ডুকে নিয়ে ভাবা যাক। পাণ্ডু শব্দের একটি অর্থ "হলদে"...অন্যটি "ফ্যাকাসে"।  সুতরাং বলা যেতে পারে যে জন্মের সময় পাণ্ডুর অ্যানিমিয়া বা জন্ডিস....কোনো একটা ধরা পড়েছিল। প্রশ্ন হলো, এই অ্যানিমিয়া আর জন্ডিস কি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল? আমার মনে হয়…"না"।

পাণ্ডুর জন্মের বেশ কয়েক বছর পরে যখন ভীষ্ম কুরু রাজসিংহাসনকে তার যোগ্য উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দিতে চান, তখন "ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ, ওর রাজা হওয়ার যোগ্যতা নেই" বলে সিংহাসনের উপর ধৃতরাষ্ট্রের অধিকারকে নাকচ করে দেন বিদুর। সেই সঙ্গে "পাণ্ডু সুস্থ এবং বলিষ্ঠ...অস্ত্রচালনায় নিপুণ" বলে পাণ্ডুকেই রাজা করার প্রস্তাব দেন বিদুর। পাণ্ডু রাজা হন এবং একের পর এক রাজ্য জয় করে কুরুরাজ্যকে প্রায় আজকের দিনের বাংলাদেশ অবধি বিস্তৃত করেন।

ভাবুন একবার, কোনো অ্যানিমিক এবং আজন্ম জন্ডিসে ভোগা যুবক কি নিজের বাহুবলে রাজ্যবিস্তার করতে পারতেন? না। কোনো অ্যানিমিক এবং হলুদ চামড়ার যুবকের গলায় কি তখনকার দিনের ডাকসাইটে সুন্দরী কুন্তী বরমাল্য পড়াতেন? মনে হয় না।

সুতরাং এই কথা অনস্বীকার্য যে পাণ্ডুর জন্মকালীন গায়ের রঙের কারণ থ্যালাসেমিয়া বা ওই ধরণের কোনো হিমোগ্লোবিনোপ্যাথি কিংবা প্যাথলজিক্যাল জন্ডিসের (সেসব রোগের লিস্ট অনেক বড়...এখানে অপ্রয়োজনীয়) জন্য নয়, তা নিতান্তই ফিজিওলজিকাল জন্ডিস এবং প্রিম্যাচিউরিটির (বা ওই ধরণের কিছু) জন্য যা বয়স বাড়ার সঙ্গে ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

এবারে আরেকটু এগিয়ে যান। পাণ্ডু গেছেন মৃগয়া করতে। জঙ্গলের মধ্যে হরিণের সন্ধান করছেন তিনি। এদিকে ঋষি কিন্দম একটু দূরেই নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। ভুল হয়ে গেল পাণ্ডুর। জঙ্গলের লতাপাতার মধ্যে দিয়ে কিন্দমকে দেখে তিনি হরিণ ভেবে বসলেন...এক বাণে কিন্দম এবং তাঁর স্ত্রীকে বিদ্ধ করলেন!

কিন্দমের স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন...মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকলেন কিন্দম। কিন্দমের আর্তনাদ শুনে ছুটে এলেন পাণ্ডু...বুঝতে পারলেন যে তিনি কি ভুল করেছেন! শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে কিন্দম পাণ্ডুকে বললেন, "স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করার সময় তুমি আমাকে মারলে পাণ্ডু? জেনে রাখো, তুমি যেদিন কামনার বশবর্তী হয়ে নিজের স্ত্রীকে স্পর্শ করবে...সেই মুহূর্তে তোমার মৃত্যু হবে!"

বিষন্ন মনে হস্তিনাপুর ফিরে এলেন পাণ্ডু। দাদা ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, "এবার থেকে রাজ্যপাট তুমিই সামলাও দাদা...আমি চললাম।" নিজের স্ত্রী কুন্তী এবং মাদ্রিকে নিয়ে হিমালয়ে চলে এলেন পাণ্ডু। কুন্তী এবং মাদ্রি কিন্তু কিন্দমের অভিশাপের ব্যাপারটা জানতেন...তাঁরা সে ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন। পাণ্ডুর দ্বারা সহবাস সম্ভব নয়...নিজের দৈব মন্ত্রের জোরে ধর্ম, পবন এবং ইন্দ্রকে আহ্বান করে কুন্তী যুধিষ্ঠির, ভীম এবং অর্জুনের মা হলেন...অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করে মাদ্রি হলেন নকুল এবং সহদেবের মা।

কিন্তু ভবিতব্য। একদিন এক মনোরম পরিবেশে কামনার বশবর্তী হয়ে মাদ্রিকে স্পর্শ করলেন পাণ্ডু। পরক্ষণেই পাণ্ডুর প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়লো মাটিতে...ঋষি কিন্দমের অভিশাপ ফলে গেল!

ব্যাস...এই অবধি জানলেই চলবে। আমরা সকলেই এই গল্প অনেকবার পড়েছি। কিন্তু, এই গোটা গল্পের মধ্যে অনেকগুলি জায়গা আছে যা ঠিক মেলে না...ফাঁক থেকে যায়...অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কি সেই প্রশ্নসমূহ?

প্রশ্ন ১: বিচিত্রবীর্য নিজের দুই স্ত্রীর সাথে বেশ কিছুদিন সহবাস করেছিলেন; কিন্তু কোনো সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। কেন? আদেও কি তিনি সহবাস করেছিলেন?

প্রশ্ন ২: বিচিত্রবীর্য রাজা হওয়া সত্ত্বেও কখনও কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। কেন?

প্রশ্ন ৩: বিচিত্রবীর্য যক্ষা রোগে মারা গিয়েছিলেন। সে যুগে মাইক্রোস্কোপ ছিলো না, টিবির জীবাণু চোখে দেখে ডায়াগনসিস করার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। অনুমান করা যায় যে কেবলমাত্র কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং তার সঙ্গে রক্ত পড়া… এই দুই উপসর্গের উপর ভিত্তি করেই যক্ষা ডায়াগনস করা হয়েছিল। কিন্তু এই উপসর্গ আরও অনেক রোগেই হয়। সত্যিই কি তাঁর টিবি হয়েছিল? না কি অন্য কোনো রোগ?

প্রশ্ন ৪: "কামনার বশে স্ত্রীকে স্পর্শ করলেই মরবে"...এই অভিশাপ পাওয়ার পরে পাণ্ডু সিংহাসন ত্যাগ করলেন কেন? "রাজ্যশাসন বা যুদ্ধবিগ্রহ করলেই মরবে"...এই অভিশাপ তো তাঁর ছিলো না।

প্রশ্ন ৫: স্ত্রীর স্পর্শ থেকে মৃত্যু আসবে...তো সেই মৃত্যুকে দূরে রাখবার জন্য রাজ্যপাট ছেড়ে পাণ্ডু বনবাসে গেলেন...স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে গেলেন কেন? তাঁর তো উচিত ছিলো স্ত্রীদের হস্তিনাপুরে রেখে একা বনবাসে যাওয়া। সেফ থাকার সেটাই তো মোক্ষম উপায় ছিলো...তাই না?

প্রশ্ন ৬: বিচিত্রবীর্য এবং পাণ্ডু...দুজনেই মারা গেলেন কম বয়সে...দুজনেরই দুটি করে স্ত্রী...দুজনেই নিঃসন্তান...বিচিত্রবীর্য কোনদিনই যুদ্ধ করেননি, পাণ্ডু জীবনের শেষ তেরো বছর কোনো যুদ্ধ করেননি। দুজনের মধ্যে এতো মিল কেন?

প্রশ্ন ৭: অনেক মহাভারত বিশেষজ্ঞের মতে পাণ্ডুর "ইম্পোটেণ্সি" বা "ইরেকটাইল ডিসফাংশন" ছিলো...অর্থাৎ তিনি সহবাসে অক্ষম ছিলেন। তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, "I beg to differ"...আমি আপনাদের সঙ্গে একমত নই। তার কারণ, ইরেকটাইল ডিসফাংশনের রোগী সহবাসে অক্ষম হন ঠিকই...কিন্তু তাতে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে না।

মহর্ষি বেদব্যাস মহাভারত রচনার প্রাক্কালে সিদ্ধিদাতা গণেশকে আহ্বান করে অনুরোধ করেছিলেন, "মানবসভ্যতার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য রচনা করব বলে মনস্থির করেছি...আমি বলবো...আপনি দয়া করে লিখে দিন।" গণেশ উত্তর দিয়েছিলেন, "বেশ তো...লিখে দেবো। কিন্তু আমার কলম যদি একবার থেমে যায়...তাহলে কিন্তু আমি আর লিখবো না।" ব্যাসদেব উত্তর দিয়েছিলেন, "যথা আজ্ঞা প্রভু...আপনার শর্ত মেনে নিলাম। কিন্তু আমারও একটা শর্ত আছে। সেটা হলো...আমার প্রতিটা শ্লোকের অন্তর্নিহিত না বুঝে আপনি সেটা লিখতে পারবেন না।"

শুনেছি, মহাভারতের এক একটি শ্লোকের অন্তর্নিহিত অর্থ এতোটাই ব্যাপক যে মহাজ্ঞানী গণেশকেও তার অর্থ বুঝতে খাগের কলমের পিছন চেবাতে হয়েছিল...মাথা চুলকাতে হয়েছিল...গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে হয়েছিল। সেই অবকাশে ব্যাস পরের শ্লোকগুলি রচনা করতেন!

ভাবুন তো...পাণ্ডুর মতো একজন দিগ্বিজয়ী রাজা...হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলেন যুদ্ধের স্ট্রেস নেওয়া তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না...সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন...এক্সাইটমেন্ট সহ্য হচ্ছে না...শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। এইভাবে তো আর রাজ্যশাসন হয় না। ছেড়ে দিলেন সিংহাসন...চলে গেলেন হিমালয়ে...মনে আশা...যদি স্বাস্থ্য ফেরে। কিন্তু দিনের পর দিন রোগ যেন আরও চেপে ধরছে...স্ত্রী সহবাসও করতে পারেন না...ক্লান্ত লাগে...শ্বাসকষ্ট হয়। এইভাবে কেটে যায় কয়েক বছর। শেষে একদিন জোর করে...নিজের অক্ষমতাকে উপেক্ষা করে স্ত্রীকে কাছে টানার চেষ্টা করেন...তৎক্ষনাৎ মরণ কামড় দেয় শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই রোগ...প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ে পাণ্ডুর।

কি সেই রোগ যা অকস্মাৎ মৃত্যু ঘটায় একজন যুবক বা প্রৌঢ় মানুষের? যা প্রবাহিত হয় বংশধারায়? যে রোগ ডায়াগনোস করবার পরেই কার্ডিওলজিস্টরা সেই রোগীর আত্মীয়দেরও পরীক্ষা করে দেখেন? বলবো পরদিন।

কখনও দেখেছেন তরুণ তুর্কি যুবকের এমন আকস্মিক মৃত্যু। দেখেছেন...একটু মনে করার চেষ্টা করুন। ২০০৪ সাল...মোহনবাগান বনাম ডেম্পো...ফেডারেশন কাপ ফাইনাল...বেঙ্গালুরুর মাঠ। ওয়ান ইস টু ওয়ান পজিশনে ডেম্পোর স্ট্রাইকার জুনিয়র এবং মোহনবাগানের গোলকিপার সুব্রত পাল...জুনিয়রের সামনে ২-০ করার সুযোগ...এক্সসাইটমেন্ট! গোলে বল ঠেললেন জুনিয়র...সুব্রত পালের সঙ্গে ছোট্ট একটা ধাক্কা...মাটিতে পড়ে গেলেন জুনিয়র...আধ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু! ময়না তদন্তে দেখা গেলো, সুব্রত পালের সঙ্গে সংঘর্ষে তেমন বড় কোনো দৈহিক আঘাত লাগেনি জুনিয়রের! তাহলে হলো টা কি? ...

মহাভারত এবং কুরুবংশ... সিদ্ধান্ত এবং স্বীকারোক্তি পর্ব: ডাঃ ইন্দ্রনীল আইচ


আমাদের হৃদপিণ্ডে বা হার্টে চারটি প্রকোষ্ঠ বা চেম্বার থাকে। উপরের দুটি চেম্বারের নাম বাম এবং ডান অলিন্দ (লেফট এবং রাইট অ্যাট্রিয়াম) এবং নীচের দুটি চেম্বারের নাম বাম এবং ডান নিলয় (লেফট এবং রাইট ভেন্ট্রিকল)।



উপরের ছবিটা দেখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। এর মধ্যে লেফট ভেন্ট্রিকল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই চেম্বারটি অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তকে পাম্প করে আমাদের শরীরের সমস্ত অংশে পৌঁছে দেয়। এই লেফট ভেন্ট্রিকল থেকে বার হয় মহাধমণী বা অ্যাওর্টা, যার মাধ্যমে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত শরীরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে পৌঁছায়।

স্বাভাবিক অবস্থায় লেফট ভেন্ট্রিকল মিনিটে প্রায় বাহাত্তর বার স্পন্দনের মাধ্যমে 1.5 লিটার রক্ত অ্যাওর্টায় ইজেক্ট করে। এটাকে বলে "কার্ডিয়াক আউটপুট"। আমরা যখন বসে বা শুয়ে থাকি...কিংবা ঘুমাই...তখন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অক্সিজেনের চাহিদা কম থাকার জন্য কার্ডিয়াক আউটপুটের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে কমে যায়। কিন্তু যখন আমরা কোনো উত্তেজনা অনুভব করি (দুঃসংবাদ, যৌন উত্তেজনা ইত্যাদি) তখন কার্ডিয়াক আউটপুটের পরিমাণ 50% থেকে 100% বেড়ে যায়...অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমরা যখন কোনো পরিশ্রমের কাজ করি (যেমন দৌড়, কুস্তি, সহবাস) তখন কার্ডিয়াক আউটপুটের পরিমাণ 700% পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে অর্থাৎ স্বাভাবিকের থেকে প্রায় সাত গুণ হয়ে যেতে পারে [Review of Medical Physiology 21st edition by William F Ganong page 574]।

সুস্থ এবং সবল হার্ট, স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে হৃদস্পন্দনের হার (হার্ট রেট) বাড়ানোর মাধ্যমে অনায়াসে এই বর্ধিত চাহিদার যোগান দেয়। কিন্তু যে হার্টের লেফট ভেন্ট্রিকলের পেশী বা হার্ট মাসল ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা যে হার্টের ভেন্ট্রিকল এবং অ্যাওর্টার সংযোগস্থলে কোনো বাধা থাকে...সেই হার্ট...রেট বাড়িয়েও এই বর্ধিত চাহিদার যোগান দিতে পারে না।

হাইপারট্রফিক অবসট্রাকটিভ কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Hypertrophic obstructive cardiomyopathy) বা HOCM বা HCM নামক হার্টের একটি অসুখ আছে। এই অসুখে যারা ভোগেন তাঁদের লেফট ভেন্ট্রিকলের দেওয়ালটা অতিরিক্ত পুরু হয় এবং লেফট ভেন্ট্রিকল ও অ্যাওর্টার সংযোগস্থলটি (outflow tract) অত্যন্ত সরু হয় (উপরের ছবি দ্রষ্টব্য)। এর ফলে উত্তেজনা বা ভারী কাজ করবার সময় এঁদের লেফট ভেন্ট্রিকল হাজার চেষ্টা করেও শরীরের চাহিদা অনুসারে রক্ত অ্যাওর্টাতে থ্রো বা ইজেক্ট করতে পারে না। এইসময় রোগী শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন।

স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র আরও হার্ট রেট বাড়ানোর মাধ্যমে কার্ডিয়াক আউটপুট বাড়াতে চেষ্টা করে। একসময় হার্ট রেট মিনিটে প্রায় 200র কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে হার্টের নিজস্ব ফিডিং আর্টারি (যার মাধ্যমে হার্ট মাসলের ব্লাড এবং অক্সিজেন সাপ্লাই হয়...করোনারি আর্টারি) তেও উল্লেখযোগ্যভাবে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ঘাটতি পড়ে। ফলে আকস্মিকভাবে কার্ডিয়াক আউটপুট এক ঝটকায় 0% এ নেমে আসে। রোগী অজ্ঞান হয়ে যান এবং তাঁর হার্ট কয়েক সেকেন্ড থিরথির করে কাঁপবার পরে (Ventricular fibrillation) চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

HOCM সম্পূর্ণভাবে জিনঘটিত রোগ...বংশধারায় প্রবহমান। কোনো মানুষের যদি HOCM থাকে তবে তাঁর সন্তানদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় 50%। সেইজন্য চিকিৎসকরা HOCM রোগীদের বাবা মা এবং সন্তানদের স্ক্রিনিং এবং কাউন্সিলিং করে থাকেন। ছেলেদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব মেয়েদের তুলনায় বেশী এবং কমবয়সী স্পোর্টসম্যানদের অন ফিল্ড আকস্মিক মৃত্যুর জন্য (Sudden cardiac death) HOCM সর্বাপেক্ষা বেশী দায়ী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ কিছু প্রাথমিক উপসর্গ (premonitory sign)দেখায় (যেমন শ্বাসকষ্ট)। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যুর পরে ময়নাতদন্ত করে জানতে পারা যায় যে তাঁর HOCM ছিলো।

পাণ্ডুর বয়স, লিঙ্গ, অকালে রাজ্যপাট এবং যুদ্ধবিগ্রহ থেকে অব্যাহতি নেওয়া এবং যৌন উত্তেজনার সময় আকস্মিক মৃত্যু...এই বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যালোচনা করবার পরে মৃত্যুর কারণ হিসাবে HOCM ছাড়া আর কোনো রোগের কথা মাথায় আসে না। হ্যাঁ...একথা সত্যি যে কমবয়সী ব্যাক্তির আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসাবে আরও কয়েকটি রোগ দায়ী...কিন্তু HOCM এর প্রিভ্যালেন্স এবং পার্সেন্টেজের কাছে বাকি রোগগুলি নেহাতই শিশু। আমাদের মেডিসিনের শিক্ষকরা বলতেন, "If you diagnose rare diseases...you will be rarely correct."

আচ্ছা আপনি মাঝে মাঝে গলা পরিষ্কার করার জন্য খাঁকারি দেন? নিশ্চয়ই দেন। গলা খাঁকারি দেওয়ার সময় যে কফটা আপনি গিলে ফেলেন বা বাইরে ফেলে দেন...একবারও ভেবে দেখেছেন যে সেই কফটা এলো কোথা থেকে? যখন আপনি সর্দিগর্মিতে ভুগছেন তখনও আপনার গলায় কফ আসে। আচ্ছা...কফটা তো জমেছে আপনার ফুসফুসের মধ্যে...সেটা গলায় উঠে এলো কি করে?

আমাদের শ্বাসনালীর দেওয়ালটা যে কোষগুলি দিয়ে তৈরী...সেই কোষগুলির বাইরে একটি করে আণুবীক্ষণিক লোম বা রোঁয়া (cilia) লাগানো থাকে। এই কোষগুলি থেকে মিউকাস (mucus)নামক একটি আঠালো পদার্থ নিঃসৃত হয়। আমরা যখন শ্বাস নিই, তখন বাইরের বাতাস থেকে অসংখ্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ ধূলিকণা, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের শ্বাসনালীর গায়ে অবস্থিত আঠালো মিউকাসে সেগুলো আটকে যায় এবং কোষের সঙ্গে আটকানো রোঁয়াগুলির ছন্দবদ্ধ গতির মাধ্যমে (escalator action) সেগুলি গলায় উঠে আসে। আমরা সেই মিউকাস, ধুলো এবং ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রনকেই কফ বলে জানি।

কিন্তু যদি কখনও এই রোঁয়াগুলি তাদের ছন্দবদ্ধ গতি বন্ধ করে দেয়...তখন কি হবে? সেক্ষেত্রে মিউকাস ধূলিকণা এবং ব্যাকটেরিয়াকে ট্র্যাপ করবে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোকে ফুসফুস থেকে গলায় তুলতে পারবে না। এর ফল কি? কফ ফুসফুসের ভিতরে জমে যাবে এবং জমতে জমতে শ্বাসনালীকে ফুলিয়ে দেবে। এই রোগের নাম ব্রঙকিয়েকটেসিস। শুধু তাই নয়। সেই কফের মধ্যে জমা ব্যাকটেরিয়া মিউকাস থেকে পুষ্টি পাবে। ফল...নিউমোনিয়া! আর যদি সেই ব্যাকটেরিয়ার নাম মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস হয়...তাহলে যক্ষা বা টিবি!

এই রোঁয়া কিন্তু আমাদের নাকের মিউকাস মেমব্রেনেও আছে। সেখানকার রোঁয়া যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এই কফ সেখানেও জমবে...ব্যাকটেরিয়া সেখানেও বৃদ্ধি পাবে...ব্যাকটেরিয়া থেকে নিঃসৃত টক্সিন নাকের ভিতরের অঙ্গসমূহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে...এর ফলে শ্বাসের সঙ্গে বিশ্রী দুর্গন্ধ বার হবে...অ্যাট্রফিক রাইনাইটিস!

আবার ছেলেদের শুক্রাশয়ের মধ্যের কোষগুলির রোঁয়ার গতি ব্যাহত হলে শুক্রাণুর পরিণত হওয়ার প্রণালী ব্যাহত হয়...ফল ইনফার্টিলিটি।

এই রোঁয়া বা ciliaর ছন্দবদ্ধ চলন কয়েকটি জিনের উপর নির্ভরশীল। এই জিনগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ciliaর স্বাভাবিক চলন বন্ধ হয়ে গিয়ে মিউকাস বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে (যেমন ফুসফুস, নাক, কানের middle ear cavity) জমে গিয়ে ব্রঙকিয়েকটেসিস, ইনফার্টিলিটি, ওটাইটিস মিডিয়া, অ্যাট্রফিক রাইনাইটিসের মতো রোগের জন্ম দেয়...যার উপরে ব্যাকটেরিয়া বাসা বেঁধে নিউমোনিয়া বা টিবির মতো রোগের জন্ম দিতে পারে। এই রোগটির পোশাকি নাম "প্রাইমারি সিলিয়ারি ডিসফাংশন" (Primary ciliary dysfunction) বা "কার্টাজেনার সিনড্রোম" (Kartagener syndrome)...যা একটি জিনঘটিত রোগ (Autosomal recessive)...বংশধারায় প্রবহমান।

এর আগের দুইপর্বের আলোচনা এবং উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।

সিদ্ধান্ত ১: সত্যবতী "প্রাইমারি সিলিয়ারি ডিসফাংশন" জনিত অ্যাট্রফিক রাইনাইটিসে ভুগছিলেন।

সিদ্ধান্ত ২: সত্যবতীর শরীর থেকে "প্রাইমারি সিলিয়ারি ডিসফাংশন" এর জিন বিচিত্রবীর্য্যের শরীরে প্রবাহিত হয়ে তাঁকে ব্রঙকিয়েকটেসিস এবং ইনফার্টিলিটি রোগে আক্রান্ত করেছিল (কার্টাজেনার সিনড্রোম)। এই ব্রঙকিয়েকটেসিসের উপর সুপারইনফেকশন হিসাবে টিবি রোগের আক্রমণে তিনি অকালে সন্তানহীন অবস্থায় মারা যান।

সিদ্ধান্ত ৩: পাণ্ডুর অকালে রাজ্যপাট, যুদ্ধবিগ্রহ ত্যাগ করা এবং যৌন উত্তেজনার মুহূর্তে কম বয়সে আকস্মিক মৃত্যু...HOCM ছাড়া আর কোনো কারণে সম্ভব নয়...যা আরেকটি জিনঘটিত রোগ।

এইসমস্ত সিদ্ধান্তের সঙ্গে আপনাদের সামনে কিছু স্বীকারোক্তিও আমি করতে চাই।

স্বীকারোক্তি ১: পাণ্ডু HOCM এর রোগী হলেও সেই রোগের জিন ব্যাস বা অম্বালিকা...কার শরীর থেকে এসেছিল...তা আমি বুঝতে পারিনি। অম্বালিকা ছিলেন কাশী রাজকন্যা...ভীষ্ম তাঁকে হরণ করে এনেছিলেন...তাঁর সম্বন্ধে এর চাইতে বেশী কিছু মহাভারতে লেখা নেই। ব্যাস তৎকালীন মুনিঋষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ...তাঁর শরীরে এহেন কোন রোগের উল্লেখ মহাভারতে নেই। পরাশরের শরীরে এই রোগ ছিলো কি না...মহাভারতে তার কোনো বর্ণনা নেই। পাণ্ডুর সন্তানদের শরীরে এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছিলো কি না সেটা জানারও উপায় নেই...কারণ পাণ্ডু নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান।

স্বীকারোক্তি ২: কার্টাজেনার সিনড্রোমের সঙ্গে সম্পর্কিত রেটিনাইটিস পিগমেণ্টোসার একটি ভ্যারাইটি "ইউশার্স অ্যামাউরোসিস" নামক রোগের রোগীরা জন্মান্ধ হন। ধৃতরাষ্ট্র এই রোগের আওতায় পড়তেন বলে মনে হয়...আমার একসময়ের সহপাঠী, বর্তমানে আই স্পেশালিস্ট ডাঃ চান্দ্রেয়ী সাহার মতামত সেইরকমই। কিন্তু রোগটা এতোটাই বিরল...সন্দেহ থেকেই যায়। বরং জন্মান্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট এবং কনজেনিটাল গ্লকোমা ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের জন্য (যেগুলি জিনঘটিত) দায়ী বলে মনে হয়। কিন্তু এইসমস্ত রোগের সঙ্গে কার্টাজেনার সিনড্রোমের কোনো সম্পর্ক এখনও আবিষ্কার হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।

স্বীকারোক্তি ৩: জেনেটিকস মেডিকেল সায়েন্সের অন্তর্গত সর্বাধিক জটিল বিষয়। সত্যবতীর শরীরে কেন কার্টাজেনার সিনড্রোমের সমস্ত লক্ষণ পরিস্ফুটিত হলো না আর বিচিত্রবীর্য্যের শরীরে কেনই বা হলো...ডোমিন্যানট রিসেসিভের সেই হিসেব এবং অটোসোম বা এক্স লিঙ্কড ক্রোমোজোমের অংক বোঝানো ফেসবুকের এই ছোট্ট পরিসরে সম্ভব নয়। তা ছাড়া জেনেটিকসের অনেক অঙ্কই বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে থাকে।

স্বীকারোক্তি ৪: HOCM এর জন্য দায়ী জিনগুলির সঙ্গে কার্টাজেনার সিনড্রোমের জিনগুলির কোনো সম্পর্ক আমার চোখে পড়েনি। হতে পারে যে এই সম্পর্ক আমি ওভারলুক করে গেছি বা এই সম্পর্ক পরে আবিষ্কার হবে। এমনও হতে পারে যে সত্যবতী, বিচিত্রবীর্য্য এবং ধৃতরাষ্ট্রের অসুখ এবং পাণ্ডুর অসুখ...দুটি ভিন্ন ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে...এই দুটি ধারার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।

স্বীকারোক্তি ৫: মহাভারত এবং মেডিকেল সায়েন্সে আমার যে যৎসামান্য জ্ঞান আছে...তাকে কাজে লাগিয়ে আমি উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলিতে উপনীত হয়েছি। বিশ্বাস করা বা না করা আপনার ব্যাপার। এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমায় সাহায্য করেছেন আমার একসময়ের সহপাঠী, বর্তমানে আই স্পেশালিস্ট ডাঃ চান্দ্রেয়ী সাহা, বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে আমার দুই বছরের সিনিয়ার, বর্তমানে চেস্ট স্পেশালিস্ট ডাঃ অরূপ হালদার...আমাদের অরূপদা। অরূপদা এবং আমার আলাদাভাবে কিন্তু একই সময়ে কার্টাজেনার সিনড্রোমের কথাটা মাথায় এসেছিল।

কেন আমি মহাভারতের চারজন চরিত্রের মধ্যে লিংক টানার চেষ্টা করছি...একথা আপনার মনে হতেই পারে। একবারের জন্যেও ভাববেন না যে "মহাভারতের যুগে জেনেটিকসের জ্ঞান ছিলো" এই ধরণের কোনো হাস্যকর যুক্তির দাবী করবার জন্য আমি এই প্রবন্ধটি লিখলাম। হ্যাঁ...বংশগতির ধারনা অনেক যুগ আগের লোকেরও ছিলো...কিন্তু কোষের মধ্যে নিউক্লিয়াস, তার মধ্যে ক্রোমোজোম, তার মধ্যে DNA, তার মধ্যে জিন, এবং এই জিন বংশানুক্রমে চলে আসা বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী...ব্যাসদেব যতোই জ্ঞানী হন না কেন...এই কনসেপ্ট তাঁর ছিলো না...থাকতে পারে না। তাহলে আমি লিখলাম কেন?

পাঠক...একবার নিজেকে বসান ব্যাসদেবের স্থানে...ভাবুন যে আপনি মহাভারত লিখছেন। নিজের মনে মনে বানিয়ে এমন চারজন চরিত্রের অবতারণা আপনি করলেন জেনেটিকসের বিচারে সেই চরিত্রগুলির রোগ হুবহু মিলে গেলো...এটা কি একটু বাড়াবাড়ি ধরণের কল্পনা নয়? কল্পনার দ্বারা মহাভারতের জটিল গল্প হয়তো তৈরী হতে পারে...কিন্তু বংশধারায় প্রবাহিত কোনো  রোগের সাইন এবং সিম্পটমের হিসাব মেলানো...প্রায় অসম্ভব। এই ঘটনাবলী তখনই আপনি এতো নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারবেন...যদি কিনা এই সমস্ত ঘটনা বাস্তবে ঘটে থাকে এবং আপনি তার সাক্ষী থাকেন! আমার অন্ততঃ এমনটাই মনে হয়।

আমার পরের বই "মহাভারত, বিজ্ঞান এবং ইতিহাস" এ মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করবার জন্য আমি মহাভারতে বর্ণিত যে তিনটি ঘটনার আশ্রয় নিয়েছি (বাকি দুটি অ্যাস্ট্রোনমি এবং জিওগ্রাফি সংক্রান্ত)...তার একটি আপনাদের সামনে ফেলে দিলাম। সিদ্ধান্ত আপনাদের। ভেবেছিলাম ওই বইতেই এই লেখাটা প্রথমবারের জন্য প্রকাশ করবো। জয়দেবদার অনুরোধে লেখাটা ফেসবুকেই প্রকাশ করে দিলাম। জেনেটিকস সদাপরিবর্তনশীল। হয়তো HOCM এবং কনজেনিটাল ক্যাটারাক্ট এর জিনের সঙ্গে কার্টাজেনার সিনড্রোমের জিনের সম্পর্ক ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে...হয়তো সেদিন অকাট্যভাবে প্রমাণিত হবে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা...আমার আশা, আমার জীবদ্দশাতেই সেই দিনটা আসবে।



                     

Post a Comment

0 Comments