ধর্ষণ - বিচার - মৃত্যুদণ্ড বা এনকাউন্টার ও বর্তমান সমাজ লিখেছেন পার্থসারথী গিরি
ধনঞ্জয়ের ফাঁসি কিছু রোধ করতে পারেনি, যদিও ধনঞ্জয় ধর্ষণকারী ছিল না বলে গবেষক ও অনুসন্ধানীরা বলছেন। একটি ইচ্ছেপূরণের গপ্পে ক্ষমতা, প্যাট্রিয়ার্কি এবং মূর্খ মিডিয়ার ত্র্যহস্পর্শ যোগ ছিল সেটি।
তবু ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয়ে গেছে। ধনঞ্জয় সগ্গে বসে হয়ত খুশি হত দেখে যে, তার প্রাণবায়ু একটি আদিম পীড়ন ও পাপ থেকে পৃথিবীকে অন্তত মুক্ত করতে পেরেছে। কিন্তু তা হয়নি। বরং বেড়েছে।
তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে ম্যানপাওয়ার বা মানবশ্রমের অবস্থাটা ঠিক কীরকম? শামশাবাদের চারজন খুনি কি তাদের জীবিতাবস্থায় নারীমুক্তির আন্দোলনের কিঞ্চিত বার্তা জানত? সামাজিক সংস্কারের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াতে বিন্দুমাত্র কৌতূহলী হওয়ার সুযোগ ছিল তাদের? কোনো সরকার, কোনো সংগঠন, কোনো সংবাদমাধ্যম তাদের ন্যায় নীতির ন্যুনতম পাঠ দিতে পেরেছিল? মধ্যবিত্ত সুখী-সুখী নিস্তরঙ্গ পরিবারের কোনো ধারণা আছে বহির্পৃথিবীর পঙ্কিল ধুলিধূসর যাপন সম্পর্কে?
সেই চারজনের তো ফাঁসি হওয়ার সুযোগও এল না। ফাঁসি অবধি যাওয়ার প্রক্রিয়ার আয়নায় আরেকবার রাষ্ট্রের নোংরা ধান্দাবাজ মুখটা দেখার সুযোগই দিল না। তার আগেই 'বীর' পুলিশ ফেক এনকাউন্টারের চিত্র খাড়া করে রক্ত নিমেষে ধুয়ে দিল। জনতাজনার্দন হুররে বলে নিজকাজে মন দিল।
আদালত আইনসভা প্রশাসন এই সব দীর্ঘলালিত সাংবিধানিক স্তম্ভগুলি কেমন চুরচুরে আমড়াকাঠের ঢেঁকি হয়ে গেল না? এরপর প্রতিবিধান মানেই ফেক এনকাউন্টার।
যা আমরা খোলাচোখে দেখি, তার সবটাই সত্যি হয়? কখনও কোথাও এই দৃঢ়তা কেউ দেখাতে পেরেছে? যে-বাঙালি দীর্ঘ জ্যাম দেখে ট্রাফিক পুলিশকে বাপ-মা তুলে গালাগাল দিয়ে শান্তি লাভ করে, সেই বাঙালি ট্রাফিক আইন না মেনে মোড়ের মাথায় বাস থামিয়ে চড়তে যায়। এমনতর উদাহরণই সামগ্রিকভাবে বেশি নীতিপালনের তুলনায়।
অর্থাৎ একটি আমূল নষ্ট সমাজের সদস্যরা বারবার নিজের গা বাঁচাতে নায়ক খুঁজে চলেছে নিরন্তর। যে কিনা ফটাফট গুলি টুলি করে ন্যায় স্থাপন করবে। সেই পুলিশ, যে ধর্ষিতার জিডি নিতে চায়নি, রাত্রিকালে নিরীহ নাগরিক মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিয়েছে অবলীলায়, সেই পুলিশের ফেক এনকাউন্টারের তত্ত্বে জনতা স্যালুট ঠুকছে। সরকারের ছদ্মবেশী মনোরঞ্জনী ফাঁদে পড়ে টিয়াপাখি নিজের মৃত্যুসংকেতে ধেই ধেই নাচছে। কী আশ্চর্য নাগরিক সচেতনতা না?
আর সেই ঘোর প্যাট্রিয়ার্কি আমাদের চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। জোর যার মুলুক তার। যে জোর খাটাবে সেই নায়ক। সেই গলে বরমাল্য পরবে। নিরস্ত্র অসহায়, সে ভালো মন্দ যাই হোক, তার পতন আবশ্যিক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এতটাই অনীহা এসে গেল? পুরুষতান্ত্রিকতার ধড়িবাজি এতটাই আমাদের পছন্দের বিনোদন?
ইউপির বিজেপি বাহুবলী বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের কিন্তু এখনও ফাঁসি হয়নি। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে উন্নাওয়ের লোহার জনজাতির মেয়েটি আদালতে শুনানি দিতে যাচ্ছিল। পথে তাকে পোড়াল এ দেশের উচ্চবর্ণের কুলীন ব্রাহ্মণেরা। কাকে এবার পোড়ানো দরকার? কুলদীপ সেঙ্গারকে? নাকি ওই পাঁচজন ব্রাহ্মণকে? নাকি ইউপির মতো একটি বৃহৎ রাজ্যে ব্রাহ্মণ্যবাদকে? ব্রাহ্মণ্যবাদকে না পুড়িয়ে পাঁচজন ব্রাহ্মণ পুড়িয়ে কি আমরা ন্যাকা পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার হব না?
সব ধর্ষিতার পরিবার চায় অপরাধীর তাৎক্ষণিক বিচার কিংবা মৃত্যু। রাগে ক্ষোভে শোকে প্রকাশ্যে অঙ্গচ্ছেদন মুণ্ডপাত ইত্যাদিও কেউ কেউ চান। আমার পরিবারে এমন ঘটলে হয়ত তাৎক্ষণিক রাগে অন্ধ হয়ে আমিও তাই চাইব। কিন্তু এখনও তা ঘটেনি। আর ঘটেনি বলেই চাই যে, এমন সামাজিক সংস্কারের প্রচার পরিকল্পনা যা ভবিষ্যতে আর কারোর পরিবার শূন্য হতে দেবে না। নারী পুরুষ বৃদ্ধ বৃদ্ধা শিশুর আত্মসম্মান উন্নতশির থাকবে।
চাই শাসকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে। চাই আদিত্যনাথ যোগীর হিংস্র উচ্চবর্ণের দাপটকে বিচার ব্যবস্থার আয়তায় আনতে। নারী নির্যাতনে যে-পুলিশ মুচকি মুচকি হাসে, চাই সেই পুলিশকে বরখাস্ত করার আওয়াজ তুলতে। চাই পুরুষতান্ত্রিকতা নিপাত যাক শ্লোগান তুলতে।
সংগ্রামী নারীর কীর্তিকে অশিক্ষিত দরিদ্র জনমানসে পৌঁছে দিতে চাই। নারীর প্রতিভা, শ্রম, লড়াইকে প্রান্তিক জনজীবনে বারবার শোনাতে শোনাতে বিশ্বাস করাতে চাই যে বালক এবং বালিকার জীবন গড়তে কেউ যেন তফাত না করেন।
সামাজিক সংস্কার একটি ধৈর্য্যধারক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ফেক এনকাউন্টারে এই যে উদ্বাহু নেত্য, এ আদতে আমাদের আর কোনোদিন শুধরাতে দেবে না মনে হচ্ছে। প্রতিটি মানুষই যে নায়ক এবং সে নিজেই এই জনযুদ্ধের অংশীদার, এইটে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। নিজের পরিবারে সাম্যের ধারণার প্রথম পাঠ হোক। পুঁজিবাদী ভোগবাদের বোতলমুক্ত দানবের পায়ে বেড়ি পরানো প্রয়োজন। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস ফেরানো প্রয়োজন। দরিদ্রর দারিদ্র্যের অজ্ঞানতার কারণ যে আমরা শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষেরাই, পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে আমাদেরই সামনের সারিতে আনার দায়িত্ব, বারবার মনে করাতে চাই। ধর্ষক ট্রাক ড্রাইভার ও খালাসিদের জন্মদাতা অন্য কেহ নয়, আমরাই তাদের জন্ম দিয়েছি, প্রতিনিয়ত জন্ম দিচ্ছি বলে আগামীকালও একটি ধর্ষণ ঘটবে, এই সত্যটি আজ যদি আমরা না বুঝি, তবে আর কবে বুঝব?
ওই ধর্ষকদের মধ্যে আসলে আমরাই ছদ্মবেশী গুপ্ত ঘাতক বসতি গড়েছি, এ কথা ভেবে শিউরে না উঠে ফেক এনকাউন্টারে স্যালুট ঠুকে কী লাভ স্যার/ম্যাডাম?
0 Comments