The Rumour Of Abduction Of Minor Hindu Girl in Metiabruz


Metiabruz Minor Hindu Girl Abducted

জম্বুর কাঠুয়ার আট বছরের শিশু আসিফাকে মন্দিরে গণধর্ষণ হত্যার খবর সামনে আসার পরে যখন হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি পুরোপুরি কোণঠাসা, তখন এরা রাজনৈতিক কুমতলবে মিথ্যা প্রচার , ও অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেছে। আর এক্ষেত্রে, কিছু বাজারু পত্রিকা এবং  কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল সেই সব সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত জুগিয়ে যাচ্ছে। আসুন দেখি  কি সুকৌশলে একটি ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক মোড়কে মুড়ে ফেলা যায়

শুরু করি সাম্প্রতিক মেটিয়াব্রুজের নাবালিকা অপরহণ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে জয়েন্ট সিপি ক্রাইম কলকাতা পুলিশ এর একটি টুইট দিয়ে :-



এই নাবালিকা অপরহণ নিয়ে সত্য অন্বেষণ করেছেন  কিছু সচেতন মানুষ তাদের রিপোর্ট তুলে ধরলাম, পুরো রিপোর্টটা পড়বেন - তাহলে বুঝতে পারবেন কিভাবে সুকৌশলে একটি ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক মোড়কে মুড়ে ফেলা যায়।
রিপোর্টটির শেষে কিছু লিংক দিলাম সেগুলোও পড়বেন তাহলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে।




রিপোর্ট প্রকাশের শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে, রিপোর্টে উল্লেখিত প্রতিটি তথ্য সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতেই লেখা হয়েছে। প্রামাণ্য দলিল হিসেবে রয়েছে- কোলকাতা হাইকোর্টের ইন্টেরিম অর্ডার, কথিত অপহৃত নাবালিকার বাবার হাইকোর্টে জমা দেওয়া ৪৮ পাতার রিট পিটিশন, গার্ডেনরিচ থানার এফ আই আর কপি, পত্রপত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালের লিঙ্ক, পিজি হাসপাতালের মেডিক্যাল রিপোর্ট, মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বয়ানের অডিও এবং ভিডিও রেকর্ডিং। 

মামলাটি যেহেতু কোর্টে বিচারাধীন, সেহেতু আইনগত দিকগুলি খতিয়ে দেখার জন্য তথ্যপ্রমাণসহ রিপোর্টটির লিখিত রূপ কোলকাতা হাইকোর্টের জনৈক বিশিষ্ট আইনজীবীর কাছে পাঠিয়েছিলাম। এবং সেই আইনজীবীর অনুমতি সাপেক্ষেই রিপোর্টটি প্রকাশ করলাম।

Gate of Sibtainbad Imambara, Metiabruz, Kolkata [Courtesy: Wikipedia]


গত ২০শে ফেব্রুয়ারি, বাংলার প্রথমসারীর দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন-এ মেটিয়াবুরুজে নাবালিকা অপহরণ সম্পর্কিত একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটি লেখেন শুভঙ্কর বসু। খবরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল,-

১) গত ২০১৭ সালের ৯ই জুন কোলকাতা পুরসভার সাফাই কর্মী বিনোদ দাসের নাবালিকা কন্যাকে অপহরণ করা হয়েছে।

২) অভিযোগ, অপহরণকারী হলেন- মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানের বাসিন্দা মিনটু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলি। গত আটমাস ধরে ক্ষমতাবান মিনটু আলি এবং তার বাবা নাবালিকাকে তাদের ডেরায় আটক রেখেছে।

৩) নাবালিকার বাবা গার্ডেনরিচ থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন। অভিযোগ, অপহৃত নাবালিকাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

৪) পত্রিকার খবর অনুযায়ী একটি মারাত্মক অভিযোগ হল, মেটিয়াবুরুজ ডেরার ‘বাদশা’ অপহরণকারী মিনটুর এলাকায় তল্লাশি করতে পুলিশ ভয় পাচ্ছে। বিনোদ দাস-এর আইনজীবী উদয় চন্দ্র ঝা অভিযোগ করেন, পুলিশকে নির্দিষ্ট ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে মেয়েটিকে সেখানে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে। তা সত্ত্বেও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বলছে ওই এলাকায় রেড করা যাবে না।

Arial view of Metiabruz area 

৫) পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে নাবালিকার বাবা মেয়েকে ফিরে পেতে বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেছেন।

৬) মামলাটি হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের এজলাসে উঠলে, তিনি অবিলম্বে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনারকে (অপরাধ) ওই এলাকায় হানা দিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করার নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রতিদিন পত্রিকায় খবরটি প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই ভার্চুয়াল জগতে ভাইরাল হয়ে হয়ে যায়। পত্রিকাটির ওয়েবসাইট থেকে দশহাজারেরও বেশি শেয়ার হয়। এরপর সোশ্যাল মিডিয়ার নেটিজেনদের একাংশ পুলিশ প্রশাসন, মেটিয়াবুরুজ এলাকা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করেন। তারা দাবী করেন, মুসলিম অধ্যুষিত বলেই পুলিশ মেটিয়াবুরুজে মিনটু আলির ডেরায় হানা দিতে ভয় পাচ্ছে। এমনকি এও বলা হয়, পুলিশ নাকি একথা হাইকোর্টে বিচারপতি দেবাংশু বসাকের সামনে স্বীকারও করেছে।

খবরটি কয়েকদিন ব্যাপক প্রচারের পরে খবরটি থিতিয়ে যায়। প্রায় দেড়মাস থিতিয়ে থাকার পরে গত ১২ই এপ্রিল বাংলার সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা আনন্দবাজার এনিয়ে একটি খবর করে। খবরটি প্রকাশের সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে চর্চা শুরু হয়। অনেকেই সিদ্ধান্ত নেন, নাবালিকাকে উদ্ধার, মন্টু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলিকে গ্রেপ্তারের দাবীতে পথে নামবেন। উল্লেখ্য, আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লাহ-র ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বক্তব্য ও সমাজে তার প্রভাব এবং জম্মুর কাঠুয়ার আট বছরের শিশু আসিফাকে মন্দিরে গণধর্ষণের পরে যখন হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি পুরোপুরি কোণঠাসা, দেড়মাস পরে ঠিক সেইসময়েই আনন্দবাজার পত্রিকা নতুনভাবে খবরটি প্রকাশ করেছে। সেই খবরকে হাতিয়ার করে নতুনভাবে অক্সিজেন ফিরে পেতে, হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি মাঠে নেমে পড়েছে।
এবার, প্রতিদিন এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তুলনামূলক যাচাইয়ের মাধ্যমে ঘটনার সত্যতা বুঝে নেওয়া যাকঃ
২০শে ফেব্রুয়ারি, প্রতিদিন পত্রিকায় বিনোদ দাসের নাবালিকা সন্তানের অপরহণ সম্পর্কিত খবররের শুরুয়াত ছিল বেশ সিনেম্যাটিক স্টাইলে। বোঝার সুবিধার জন্য প্রথম অনুচ্ছেদটি এখানে তুলে দিলাম।

“‘সড়ক’ ছবিতে মহারানির ডেরার কথা মনে আছে? যেখানে নাকি ঢুকতেও পা কাঁপত পুলিশেরও! কলকাতা শহরেও নাকি আছে এমনই এক ডেরা! আর যেখানে ঢুকতে নাকি সত্যিই পা কাঁপে পুলিশের। মহারানির নয়। এই ডেরার বাদশা ‘মিনটু’। এক নাবালিকাকে জোর করে তুলে এনে সে নাকি আটকে রেখেছে নিজের ডেরায়। আর পুলিশ নাকি সেখানে যেতেই ভয় পাচ্ছে।“

পত্রিকার প্রতিবেদকের ‘নাকি’ যোগাযোগ  মতে, মিনটু এক নাবালিকাকে অপহরণ করে নিজের ডেরায় আটকে রেখেছে। ডেরার ‘বাদশা’ মিনটু । পুলিশ সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছে। খবরের ধরণটি দেখে স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যেতে পারে, বাদশা মিনটু বিপুল ক্ষমতাবাদ ব্যক্তি। মিনটুর ডেরা একটি দূর্গের মত যেখানে পুলিশ-প্রশাসনও যেতে ভয় পায়। একই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, নাবালিকাকে উদ্ধারের জন্য ভয়ের কারণে পুলিশ সেখানে যেতে পারেনি। সত্যিই কী পুলিশ সেখানে যেতে পারেনি?

আনন্দবাজার পত্রিকায় এই সম্পর্কিত প্রকাশিত খবরের তৃতীয় অনুচ্ছেদটির নিরিখে প্রতিদিন পত্রিকার খবরের সত্যতা যাচাই করে নেওয়া যাক। এখানে তৃতীয় অনুচ্ছেদটি তুলে দিলাম।

“বিনোদ দাস-এর পরিবারের দাবি, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওই নাবালিকার ভাইঝি তাকে ফতেপুর মোড়ে রাজাবাগান এলাকার যুবক মিনটু আলির মোটরবাইকে দেখতে পায়। এর পরেই যুবকের পরিচয়, নাম, ঠিকানাও পুলিশকে দিয়ে আসেন নিখোঁজ কিশোরীর বাবা। অভিযোগ, সেই সময়ে রাজাবাগানে ওই যুবকের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে কয়েক বার পুলিশ গেলেও ওই যুবকের খোঁজ মেলেনি। হদিস মেলেনি মেয়েরও।...”

উপরে উল্লেখিত আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বিনোদ দাসের পরিবারের দাবী অনুযায়ী স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বিনোদ দাসকে সাথে নিয়ে পুলিশ একাধিকবার রাজাবাগানে মিনটুর বাড়িতে গিয়েছে। কিন্তু যুবক এবং মেয়ে কারও খোঁজ মেলেনি। আনন্দবাজারের প্রতিবেদন থেকে সহজেই প্রমাণিত, ‘বাদশা’ মিনটুর ডেরা পুলিশ একাধিকবার হানা দিয়েছে। এমনকি নাবালিকার বাবা বিনোদ দাসকে সাথে নিয়েও হানা দিয়েছে।

অতএব, ‘বাদশা’ মিনটুর ডেরায় পুলিশ রেড করতে ভয় পায়, রেড করেনি, প্রতিদিনের প্রতিবেদনের এই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী মিথ্যা। 

বিনোদ মেহতার খুনীদের এলাকা ‘মিনি পাকিস্তান’-এ পুলিশ কী আদৌ ঢুকেছিল? সেই তথ্য আনন্দবাজার ছাড়া অন্যান্য নথি থেকে পরখ করে নেওয়া যাক।

মিনটু আলি পরিবারের বক্তব্যঃ

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নাবালিকা অপহরণ সম্পর্কিত যেসমস্ত খবরাখবর প্রকাশিত হয়েছে সেগুলিতে কোথাও মিনটুর পরিবারের বক্তব্য ছাপা হয়নি।

এমনকি কোনো মিডিয়াই তাদের বাড়িতে যায়নি। ঘটনার সত্যতা জানার জন্য ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের দুজন সদস্যকে মিনটু আলির বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। মিনটু আলির পরিবারের সাথে টিমের সদস্যদের মাধ্যমে আমি নিজেও কথা বলি। তাদের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল কিনা, এমন প্রশ্ন করতে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, -

হাইকোর্টের ইন্টেরিম অর্ডারের আগে এবং পরে গার্ডেনরিচ থানা, রাজাবাগান থানা এবং লালবাজার থানা থেকে প্রায় ২০বার পুলিশ বাড়িতে এসেছে, রেড করেছে এবং পরিবারের সদস্যদের জেরা করেছে। নাবালিকার বাবাকেও সাথে নিয়ে বাড়িতে এসেছে। শুধু তাই নয়, হাইকোর্টের ইন্টেরিম অর্ডারের আগে রাজাবাগান এবং গার্ডেনরিচ থানায় একাধিকবার ডাকা হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা মিনটুকে সাথে নিয়ে থানায় একাধিকবার গিয়েছেন। ইন্টেরিম অর্ডারের পরে লালবাজার থেকেও একাধিকবার ডাকা হয়েছে। মিনটুকে সাথে নিয়ে পরিবারের লোকজন সেখানেও গিয়েছেন। সেই সময়গুলিতে লালবাজার থানায় নাবালিকার বাবা বিনোদ দাস নিজে উপস্থিত ছিলেন।

মিনটু আলির আইনজীবীর বক্তব্যঃ

কোলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী পিনাকী ভট্টাচার্য হলেন মিনটু আলির আইনজীবী। পিনাকীবাবুর দাবী,
মাননীয় বিচারপতি দেবাংশু বসাকের সামনে বলেছেন, পুলিশ মিনটু আলির বাড়িতে একাধিকবার গিয়েছে।নাবালিকার বাবাও পুলিশের সাথে গিয়েছেন। মিনটু আলিকে থানায় যেদিন যেদিন ডাকা হয়েছে, সেদিন সেদিন সে উপস্থিত হয়েছে।

গার্ডেনরিচ এবং রাজাবাগান থানার বক্তব্যঃ

থানার তরফ থেকে হাইকোর্টে কেস ডায়েরি জমা করা হয়েছে। সেখানে তারিখ সময় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কবে কবে কোথায় কোথায় কতবার নাবালিকার খোঁজে রেড করা হয়েছে। সেইসাথে, মিনটু এবং তার পরিবারকে কবে কবে থানা ডাকা হয়েছে, সেই তথ্যও কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন, মিনটু আলি পরিবারের বক্তব্য এবং গার্ডেনরিচ এবং রাজাবাগান থানার বক্তব্য প্রমাণ  করে, ‘বাদশা’ মিনটু আলি ডেরায় পুলিশ ঢুকতে পারেনি- এই তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুয়ো, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

‘বাদশা’ মিনটু আলিঃ

প্রতিদিন পত্রিকায় মিনটু আলিকে ভয়ানক খলনায়ক বাদশা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্টে জমা করা নাবালিকার বাবা বিনোদ দাসের ৪৮ পাতার রিট পিটিশনের ১০ নম্বর পাতার ৩নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, -

মন্টু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলি ভয়ানক সমাজবিরোধী। সেইসাথে এও বলা হয়েছে, কোরবান আলি মেটিয়াবুরুজ রাজাবাগানি এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি।

এবার ফ্যাক্ট দেখে নেওয়া যাক। সোভান আলি ওরফে মিনটু আলির বাবা কোরবান আলির বয়স প্রায় চুয়ান্ন কিংবা পঞ্চান্ন বছর। পেশায় ছিলেন একজন ভ্যান রিক্সা চালক। ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে তিনি অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী। প্রথমে তিনি টিবি রোগে আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে দেখা যায়, তিনি লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিশেষ কথাবার্তা বলতে পারেন না।
বর্তমানে একুশ বছর বয়সী(১৯৯৭ সালে জন্ম) মিনটু আলি পেশায় সেলাই দর্জি। মা গৃহবধু। অত্যন্ত অভাবের সংসার। মিনটু, মিনটুর ছোটবোন এবং বাবা-মা সকলেই থাকেন দশ বাই আটের একটি ভাড়া ঘরে।

উপরের তথ্যগুলিতেই প্রমাণিত, ভ্যান রিক্সা চালক, ক্যানসার আক্রান্ত, শয্যাশায়ী অত্যন্ত দরিদ্র মানুষটি কখনই সেই এলাকার বিশাল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হতে পারেন না। দশ বাই আটের ভাড়া ঘর যা মিডিয়া ভয়ানক দূর্গ হিসেবে প্রচার করেছিল, সেটাও সত্য হতে পারে। সামান্য দরিদ্র সেলাই দর্জী মিনটুও কখনই মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ এলাকার ‘বাদশা’ হতে পারেন না। পরিবারের লোক তথা এলাকার লোকেরাও এই তথ্য বাতিল করেছে।

অতএব, মিনটু আলির পারিবারিক পরিস্থিতি, এলাকার লোকের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, প্রতিদিনের প্রতিবেদনের মত অনুযায়ী মিনটু ‘বাদশা’- একথা নিখাদ মিথ্যাচার। আবার রিট পিটিশনের দাবী অনুযায়ী, কোরবান আলি এলাকার অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি- এটাও চরম মিথ্যাচার।

নাবালিকার প্রথম নিখোঁজ রহস্যঃ-

ঘটনার অন্তর্তদন্ত করতে গিয়ে জেনেছি,
২০১৭ সালের ৭ই জুন বিনোদ দাস-এর মেয়ে তার মাসির বাড়ী থেকে প্রথমবার নিখোঁজ হয়। মাসির বাড়ির ঠিকানা- জি-৪০৯, মেহের মঞ্জিল, পোষ্ট + থানা- গার্ডেন রিচ, কোলকাতা ৭০০০২৪.

মেয়ের নিখোঁজের বিষয়ে বিনোদ দাস গার্ডেন রিচ থানায় যোগাযোগ করেন। থানায় গিয়ে তিনি জানান, মিনটু আলির সাথে তার নাবালিকা মেয়ে চলে গেছে। অত্যন্ত তৎপরতার সাথে পুলিশ মিনটুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ করে। রেডও করে। কিন্তু সেখানে মিনটু এবং নিখোঁজ নাবালিকাকে পাওয়া যায়নি। পরের দিন অর্থাৎ ৮ই জুন, মিনটুর পরিবারের লোকেরা মহেশতলা থেকে দুজনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান। সাথে এলাকার লোকেরাও ছিলেন। মেয়ের জন্য বিনোদ দাস থানায় অপেক্ষা করছিলেন। মেয়েকে বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের বক্তব্য অনুযায়ী, থানা চত্বরেই বাবা বিনোদ দাস মেয়েকে শাসানী দিতে শুরু করেন এবং বাড়ি গিয়ে শায়েস্তা করার কথা বলতে থাকেন। যাইহোক, বাবা মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে যান।
পরিবার এবং এলাকার লোকেরা ছেলেকে নিয়ে রাজাবাগানের ভাড়া ঘরে ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, এই ঘটনার সত্যতা ছেলের পরিবার, প্রতিবেশী এবং পুলিশ স্বীকার করেছে। হাইকোর্টে জমা করা কেস ডায়েরিতেও পুলিশ এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে, পুলিশ সূত্রে এমনটাই খবর। মিনটু আলির আইনজীবী পিনাকী ভট্টাচার্য হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাকের সামনেও ঘটনাটির উল্লেখ করেন।
এখন প্রশ্ন হল, ১৬ বছর বয়সী নাবালিকা ২০ বছর বয়সী মিনটু আলির সাথে কেন চলে গিয়েছিল? নিজেরা বিয়ে করার জন্য? ভারতীয় আইন অনুযায়ী তো সেই সময়ে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৬ই জুন ছেলে এবং মেয়ে কারও বিয়ের বয়স হয়নি। ভারতীয় আইন অনুযায়ী, বিয়ের জন্য মেয়ের বয়স হতে হবে সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং ছেলের হতে হবে ২১ বছর।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে পুলিশ এবং অন্যান্য সূত্র মারফৎ যে তথ্যগুলি সামনে এসেছে সেগুলি হল -

মিনটু আলি-র সাথে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। একথা মেয়ের পরিবারে জানাজানি হয়ে যায়। আর সেকারণে বিনোদ দাস ১৬ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু মেয়ে বাবাকে জানিয়ে দেয়, সে এখন পড়াশুনা করবে। বিয়ে করবে না। বাবা মেয়ের কথায় গুরুত্ব না দেওয়ায়, মেয়ে তার পছন্দের মিনটুর সাথে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

নাবালিকার দ্বিতীয় নিখোঁজ রহস্য:

প্রথমবার নিখোঁজ এবং দুদিন পরে অর্থাৎ ৯ই জুন ফিরে পাওয়ার পরে বাবা বিনোদ দাস লক্ষ্য করেন, মেয়েকে আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়ের খোঁজে তিনি প্রথমেই চলে যান মিনটু আলির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখেন, মিনটু বাড়িতেই রয়েছে, কিন্তু মেয়ে নেই। বিনোদ দাস তার পরিবারের সদস্য ও এলাকার বন্ধুদের নিয়ে মেয়েকে খুঁজতে যে মিনটু আলির বাড়িতে গিয়েছিলেন, একথা তিনি(বিনোদ দাস) হাইকোর্টে দায়ের করা রিট পিটিশনের ১১ পৃষ্ঠার ৭ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ করেছেন। মিনটুর পরিবারের দাবী, মিনটু এবং মিনটুর পরিবারের সাথে কথা বলে বিনোদ দাস নিশ্চিত হন, প্রথমবারের মতো এবার নাবালিকা মিনটুর সাথে চলে যায়নি।
অন্যান্য স্থানে খোঁজ-খবর করার পরে তিনি পরেরদিন অর্থাৎ ১০ই জুন গার্ডেন রিচ থানায় গিয়ে একটি জিডি করেন। ১০ই জুন সেই জিডির ভিত্তিতেই এফ আই আর করা হয়।

জিডি এবং এফ আই আর-এ অভিযুক্তঃ

নাবালিকার বাবা গার্ডেনরিচ থানায় মেয়ের নিখোঁজ বিষয়ক একটি জেনারেল ডায়েরি করেন এবং সেই ডায়রির ভিত্তিতে এফ আই আর করা হয়। জিডি নম্বর এবং এফ আই আর নম্বর ও তারিখগুলি হল যথাক্রমে- GDE No. 633 dated 10th June, 2017 এবং F.I.R No. 132 dated 10th June, 2017.
ডায়েরি এবং এফ আই আর-এ উল্লেখ রয়েছে যে, ৯ই জুন বিনোদ দাস-এর ১৬ বছর বয়সী তরুণীকে অজ্ঞাত দুষ্কৃতিরা অপহরণ করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হল, জিডি কিংবা এফ আই আর-এ অপহরণকারী হিসেবে অজ্ঞাত দুষ্কৃতির কথা বলা হয়েছে, নির্দিষ্টভাবে নাম উল্লেখ করা হয়নি।

অর্থাৎ জিডি এবং এফ আই আর-এ অভিযুক্ত হিসেবে মিনটু আলি বা তার বাবা কোরবান আলির নাম উল্লেখ করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ফৌজদারি মামলাটি বর্তমানে আলিপুর আদালতে বিচারাধীন।

জিডি এবং এফ আই আর পরবর্তী থানার পদক্ষেপঃ

১০ই জুন ডায়েরির পরেই বিনোদ দাসকে সাথে নিয়ে পুলিশ মিনটু আলির রাজাবাগানের ঘরে হানা দেয়। পুলিশ গিয়ে দেখে, মিনটুর বাবা অক্সিজেন মাস্ক পরে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন। অসুস্থ বাবার পাশে বসে রয়েছেন মিনটু আলি। তল্লাশি এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এবারে নাবালিকা মিনটুর সাথে পালিয়ে যায়নি। পরবর্তীতে গার্ডেন রিচ এবং রাজাবাগান থানার পুলিশ একধিকবার মিনটুর বাড়িতে হানা দিয়েছে। মিনটুকে থানাতে ডাকাও হয়েছে। মিনটু এবং তার পরিবারের লোকেরা থানায় গিয়েছেনও।
মেটিয়াবুরুজের বাজাবাগানে মিনটুর ঘরে নিখোঁজ নাবালিকা নেইঃ

১০ই জুন ডায়েরি এবং এফ আই আর-এর ভিত্তিতে পুলিশ একাধিকবার মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানে মিনটুর বাড়িতে রেড করে, মিনটু এবং তার পরিবারকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রেড এবং জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ নিশ্চিত হয়, মিনটুর মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানের বাড়িতে নাবালিকা নেই। মিনটুর স্থানীয় আইনজীবী শাহিদ আনসারীর সাথে এবিষয়ে ফোনে কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন -

হাইকোর্টে মিনটুর আইনজীবী পিনাকী ভট্টাচার্য পরিষ্কারভাবে বলেছেন, প্রথমবার মেয়ে মিনটুর সাথে গিয়েছিল। পুলিশ এবং মিনটুর পরিবারের উদ্যোগেই থানায় তার বাবার কাছে মেয়েকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার মেয়েটির সাথে মিনটু যায়নি। পুলিশ নিজেও একাধিকবার রেড এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয়েছে। হাইকোর্টে পুলিশের আইনজীবীও একই কথা জানিয়েছেন। আইনজীবী শাহিদ আনসারী দাবী করেছেন, পুলিশ হাইকোর্টে যে কেস ডায়েরি জমা করেছে সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে, মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানে মিনটুর বাড়িতে নাবালিকা আটক নেই। গতকাল অর্থাৎ ১৭ তারিখ কোলকাতা ক্রাইম ব্রাঞ্চের জয়েন্ট সিপি টুইট করে জানিয়েছেন, নাবালিকাকে কিডন্যাপ করে মেটিয়াবুরুজের বড়িতে আটকে হয়েছে বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে প্রচারণা চলছে তা পুরোপুরি মিথ্যা গুজব।


Tweet from Joint CP Crime, Kolkata Police on Metiabruz abduction  case 



হাইকোর্টে নাবালিকার বাবার রিট পিটিশনঃ

এবছরের ১৫ই জানুয়ারী, বাবার পক্ষে হাইকোর্টের আইনজীবী মহেশ্বরী শর্মা এবং উদয় চন্দ্র ঝা হাইকোর্টে ৪৮ পাতার একটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। নম্বর- W.P No. 1175(W).
রিট পিটিশনে ছয়জন রেসপন্ডেন্ট হল -

১) রাজ্য সরকার ২) কোলকাতা পুলিশ কমিশনার ৩) কোলকাতা ক্রাইমব্রাঞ্চের জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার ৪)পোর্ট ডিভিশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ৫) গার্ডেন রিচ থানার অফিসার-ইন-চার্জ এবং ৬) কোরবান আলির ছেলে মিনটু আলি।

পিটিশনে অভিযোগ করা হয়, দীর্ঘ আটমাস ধরে নাবালিকা নিখোঁজ রয়েছে। এও দাবী করা হয়েছে, মেয়েকে কিডন্যাপ করে মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানের বাড়িতে বন্দী করে রেখেছে মিনটু আলি এবং এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ও দুষ্কৃতি কোরবান আলি। মেয়েকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে পিটিশনে অভিযোগ করা হয়েছে।

রিট পিটিশনে অসঙ্গতিঃ

৪৮ পাতার রিট পিটিশনে অভিযোগের তীর মূলত ২ নম্বর থেকে ৫ নম্বর রেসপন্ডেন্ট অর্থাৎ পুলিশের বিরুদ্ধে। পিটিশনের বক্তব্য অনুযায়ী, নিখোঁজ নাবালিকাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু এই রিপোর্টেই একাধিকবার পুলিশের পদক্ষেপ গ্রহণের তথ্য তুলে ধরেছি।

দ্বিতীয়ত, রিট পিটিশনে বহু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। পিটিশনের ১০নম্বর পাতার ৩নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে, রেসপন্ডেন্ট ৬ অর্থাৎ মিনটু আলি ভয়ানক সমাজবিরোধী এবং মিনটু আলির বাবা কোরবান আলি এলাকার অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। আগেই উল্লেখ করেছি, পেশায় সেলাই দর্জী মিনটু অত্যন্ত দরিদ্র এবং সাধারণ যুবক। মিনটুর বাবা কোরবান আলি ক্যান্সার আক্রান্ত শয্যাশায়ী। পেশায় ভ্যান রিক্সাচালক কোরবান এলাকায় অত্যন্ত দরিদ্র সাধারণ নিরীহ মানুষ হিসেবেই পরিচিত।

পিটিশনের ২০ নম্বর পাতার ১৮ নম্বর এবং ২৯ নম্বর পাতার পিটিশন গ্রাউন্ডের XIII পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নিখোঁজ নাবালিকা কোথায় রয়েছে পিটিশনার বাবা আজ অবধি জানতে পারেননি। অন্যদিকে, একই পিটিশনের ১৩ পাতার ৮ নম্বর এবং ২৫ নম্বর পাতার পিটিশন গ্রাউন্ডের IV নম্বর বলে হয়েছে, প্রাইভেট রেসপন্ডেন্ট ৬ মিনটু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলি তাদের বাড়িতে নাবালিকাকে বন্দী করে রেখেছে, নির্দিষ্টভাবে পুলিশকে এই তথ্য দেওয়ার পরেও পুলিশ উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এছাড়া, পিটিশনে আরও বহু অসঙ্গতি রয়েছে। সেগুলি নিয়ে এই রিপোর্টে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। আশাকরি, কোর্টে সেগুলি আলোচিত হবে।

পিটিশনার আইনজীবীর রাজনৈতিক পরিচয়ঃ

পিটিশনার বিনোদ দাসের অন্যতম আইনজীবী উদয় চন্দ্র ঝা হলেন সক্রিয় বিজেপি নেতা। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এর প্রারম্ভিক পর্যায়ে ওয়াকিবহল মহলের থেকে এই তথ্যটি জেনেছিলাম। পরবর্তীতে আরও জানতে পারি, উদয় ঝা ২০১৫ এর কোলকাতা পুরসভা নির্বাচনে ৯০ নং ওয়ার্ড থেকে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন। এছাড়া, তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনেও পরিচয় হিসেবে লেখা রয়েছে, Worked at Bharatiya Janata Party Yuba Morcha. অনেকের মতেই, হাইকোর্টে দাখিল করা পিটিশন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।


Facebook profile of petitioner Uday Chandra Jha 


অপহরণ মামলার সাথে ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’-এর সম্পৃক্ততাঃ

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, নাবালিকা অপহরণ মামলায় ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’ নামক একটি সংগঠনের সম্পৃক্ততা। পিটিশনার বিনোদ দাস-এর দায়ের করা পিটিশনের ১৪ নম্বর পাতার ৯ নম্বর পয়েন্টের সাবপয়েন্ট (c)- তে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর, নাবালিকা অপহরণ মামলায় বিনোদ দাসের পক্ষে ‘হিন্দু একতা মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক ইমেইল মারফৎ পিটিশনের ৩ এবং ৪ নম্বর অর্থাৎ কোলকাতা ক্রাইমব্রাঞ্চের জয়েন্ট পুলিশ কমিশনার ও পোর্ট ডিভিশনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনারকে চিঠি লেখেন।

হিন্দু একতা মঞ্চ নামক সংগঠনটির বিষয়ে জানতে গুগল সার্চ করেছিলাম। গুগল থেকে যা তথ্য পেয়েছি তা হল, জম্মুর কাঠুয়াতে মন্দিরের ভিতর গণধর্ষণ এবং হত্যার শিকার ৮বছরের আসিফার অভিযুক্ত ধর্ষণকারী ও হত্যাকারীদের পক্ষে প্রতিবাদ, শ্লোগান, বিক্ষোভ, সমাবেশ যে সংগঠনটি করেছে তার নামও -‘হিন্দু একতা মঞ্চ’।

Hindu Ekta Manch Waves Tricolour in Support of Rape Accused in Jammu


কোর্টের অন্তরবর্তী আদেশ বা ইন্টেরিম অর্ডারঃ

নাবালিকা অপহরণ এবং মেটিয়াবুরুজের রাজাবাগানে মন্টু আলি ও তার বাবা কোরবান আলির বাড়িতে বন্দী করে রাখার বিষয়টি নিয়ে যখন ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তখন সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এফ আই আর কপি, রিট পিটিশনের কয়েকটি পাতা এবং হাইকোর্টের অন্তরবর্তী আদেশ দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, ঘটনা সত্য।

FIR Copy filed in Garden Reach police station


নাবালিকা যে নিখোঁজ, সেনিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। মূল প্রশ্ন হল, নাবালিকাকে কী মিনটু আলি এবং তার বাবা কোরবান আলি অপহরণ করে ঘরে বন্দী করে রেখেছেন? এফ আই আর কপি এবং হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক অন্তরবর্তী রায় থেকে কী একথা প্রমাণ হয় ?

আগেই উল্লেখ করেছি, বিনোদ দাসের করা ডায়েরি এবং তার ভিত্তিতে তৈরি এফ আই আর কপিতে অপহরণকারী হিসেবে মিনটু আলি, কোরবান আলি বা অন্য কারও নাম উল্লেখ নেই। এফ আই আর-এ বলা হয়েছে, অজ্ঞাত দুষ্কৃতিরা নাবালিকাকে অপহরণ করেছে।

দ্বিতীয়ত, গত ২৪শে জানুয়ারী হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক যে ইন্টেরিম অর্ডার দিয়েছেন, সেখানে তিনি রেসপন্ডেন্ট ৫ অর্থাৎ গার্ডেন রিচ থানার অফিসার-ইন-চার্জকে নিখোঁজ নাবালিকাকে উদ্ধারের জন্য তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে ফেব্রুয়ারী মাসের ২ তারিখে হাইকোর্টে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা করতে আদেশ দেন। সেইসাথে নাবালিকাকে উদ্ধারের জন্য কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটাও জানাতে বলা হয়েছে।

একাধিক আইনজ্ঞের সাথে এবিষয়ে আলোচনা করে জেনেছি, নিখোঁজ বা কিডন্যাপ কেসের বিষয়ে পিটিশন দায়ের করলে, মহামান্য আদালত এমনই আদেশ দিয়ে থাকেন।

অন্যদিকে, দাখিল করা পিটিশনের ভিত্তিতে বিচারপতি দেবাংশু বসাক যদি মেনে নিতেন, মিনটু আলি এবং কোরবান আলি মেয়েকে তাদের বাড়িতে আটমাস ধরে বন্দী করে রেখেছেন, তাহলে প্রথমেই পুলিশকে তাদের গ্রেপ্তারের আদেশ দিতেন। কিন্তু তিনি তাঁর আদেশে মিনটু আলি বা তার বাবা কোরবান আলিকে গ্রেপ্তার বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে বলেননি।

অন্যদিকে, মিনটু আলির আইনজীবী হিসেবে পিনাকী ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন এবং মিনটু আলির পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেছেন। একথাও বিচারপতির অন্তরবর্তী আদেশেই রয়েছে। উল্লেখ্য মিনটু আলি পলাতক নয়। কারণ সে তার ওকালতনামায় নিজেই সই করেছে। এমনকি, আদালতে আইনজীবী পিনাকী ভট্টাচার্যের বক্তব্যে বিচারপতি বসাক কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করেননি। বক্তব্য নিয়ে কোনো প্রশ্নও তোলেননি। কোর্টের ভেতর বা অন্তরবর্তী আদেশে কোথাও প্রশ্ন তোলেননি।

২রা ফেব্রুয়ারি পুলিশের রিপোর্টঃ

বিচারপতি দেবাংশু বসাক তার অন্তরবর্তী আদেশে গার্ডেন রিচ থানার ওসিকে ২রা ফেব্রুয়ারি তদন্ত রিপোর্ট জমা করতে বলেছিলেন। ইতিমধ্যেই অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, নির্দিষ্ট দিনে পুলিশ রিপোর্ট কেন জমা করেনি? বিনোদ দাস-এর আইনজীবী উদয় চন্দ্র ঝা-এঁর বরাত দিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাও একই প্রশ্ন তুলেছে।

এবিষয়ে, পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে হাইকোর্টে স্ট্রাইক চলার কারণে হাইকোর্টে কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। নির্দিষ্ট দিন অর্থাৎ ২রা ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বন্ধ থাকায় তদন্ত রিপোর্ট বিচারপতি দেবাংশু বসাকের এজলাসে জমা করা সম্ভব হয়নি। কোর্টের কাজকর্ম শুরু হলেই বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট জমা করা হবে। যদিও হাইকোর্টে পুলিশের কেস ডায়েরি জমা রয়েছে।

মেয়েটির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায়নি। পুলিশ সূত্রের খবর রহস্য উন্মোচনের জন্য ও মেয়েটির হদিশ পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আশাবাদী মেয়েটি সুস্থ শরীরে সমাজে ফিরে আসুক।

উপরের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার যে, আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লাহ-র ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বক্তব্য ও সমাজে তার প্রভাব এবং জম্মুর কাঠুয়ার আট বছরের শিশু আসিফাকে মন্দিরে গণধর্ষণ হত্যার খবর সামনে আসার পরে যখন হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি পুরোপুরি কোণঠাসা, তখন রাজনৈতিক কুমতলবে মিথ্যা, বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেছে। আর এক্ষেত্রে, প্রতিদিন পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালের হলুদ সাংবাদিকতা সেই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত জুগিয়ে যাচ্ছে ।

সকলের কাছে অনুরোধ, বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আগামীতেও সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাবে। তাই, আমাদের সকলেরই উচিত, সাম্প্রদায়িক খবরগুলি বিশ্বাস করার আগে বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে খতিয়ে দেখে নেওয়া।

আমার বিশ্বাস এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টের পরে, হলুদ মিডিয়ার সাম্প্রদায়িক খবরাখবর এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনো তত্ত্ব এবং তথ্য শান্তিকামী সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করবে না।

ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের সঙ্গে যুক্ত সকল সদস্য অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং সততার সাথে কাজ করেছেন। নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সদস্যদের নামগুলি উল্লেখ করলাম না। সকলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা, আদর এবং কুর্নিশ রইল। ফ্যাক্টগুলি কালেক্ট করার পরে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সালমান অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহায়তা করেছে। সালমানের অনুমতি নিয়েই ওর নামটি উল্লেখ করলাম।


রিপোর্টটি লিখেছেন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমের পরিচালক Zim Nawaz

Post a Comment

0 Comments