শান্তিনিকেতন ও বিপন্ন পরিয়ায়ী পাখিরা - শ্রেয় সেনগুপ্ত, এম এফ এ, পিএইচ ডি কলাভবন, (চিত্রকলা বিভাগ) শান্তিনিকেতন, বোলপুর




❑ শান্তিনিকেতন ও বিপন্ন পরিয়ায়ী পাখিরা

এক শীতের ভোরে ঘুম ভাঙল খুব জোর বাঁশির মত শব্দে। ঠিক যেন কেউ তালপাতার বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলেছে। একটা দুটো নয়, অনেক অনেক বাঁশি। এই শব্দের সাথে আমি আগেই পরিচিত ছিলাম যদিও, ঘুম চোখে দেখি ঘড়িতে প্রায় পৌনে পাঁচটা। সূর্য উঠতে তাও এখনও অনেকটা দেরি। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখি কুয়াশাতে আকাশটা ঘোলাটে আর গাঢ় নীলচে মায়াবি রঙ মেখে। সামনের পাতা ঝরে যাওয়া অর্জুন গাছের মগডালের শাখাগুলোতে তৃতীয়ার চাঁদ আটকে আছে টিমটিম করে কিছুটা অস্পষ্ট কুয়াশার আবরণে। আকাশ থেকে ভেসে আসছে সেই হুইসলের মত আওয়াজ আর সাথে বইছে হু হু করে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাস। কম্বল গায়ে দিয়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে বাগানে আস্তেই শুনতে পেলাম হর্ন এর মত করেও আওয়াজ করে আরো কারা যেন এগিয়ে আসছে, শব্দটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কুয়াশাতে ভাল করে বুঝতে পারিনি কয়বার। একটু হালকা হতেই আকাশে তাকিয়ে দেখি ইংরেজি ‘V’ শেপের আকার নিয়ে একদল রাজহাঁস। ভাল করে বাইনোকুলারটা লাগিয়ে দেখি অবিশ্বাস্য! এতো গ্রে ল্যাগড গুস!

বিশাল বিশাল ডানার ঝাপটের আওয়াজে চারদিকে যেন গমগম করছে। ঘুম ঘুম চোখে দেখি সাথে অনেক অনেক লেসার হুইস্লিং টিল আমার ভাড়াবাড়ির ওপর দিয়ে ঊড়ে যাচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ওরা এদিকেই আসছে। বাগানের ওপর দিয়ে উড়ছে। আবার ফিরে আসছে। বারবার চক্কর কাটছে, যেন ছাদে গেলেই কথা বলা যাবে। এর মধ্যেই মিশে আছে কিছু পিনটেইল আর গাডওয়েল। ভাবুন একবার! মঙ্গোলিয়া থেকে এভারেস্ট টপকে সোজা শান্তিনিকেতনে। এর আগেই উত্তর ইউরোপ আর রাশিয়ার সাইবেরিয়ার বাসিন্দারা আস্তে শুরু করেছিল ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই। স্বপ্ন নয়! পাখির নেশায় ভারতের কতই না প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছি। আর সেই সব পরিযায়ীরা পাখিরা আমারই নতুন বাড়ির অতিথি!

আলেকজান্দ্রিয়া বা ইস্তানবুল থেকে গোবি মরুভূমি বা এই বাইকাল লেক থেকে খোভসগুল, ইয়াং শিকিয়াং হয়ে লাসা। সেখান থেকে তুষারশুভ্র গ্রেট হিমালয়, ভোরের মায়াবী কাঞ্চনজঙ্ঘা পিক পেরিয়ে এখানে। ঠিক যেন গেছোদাদার রুট - রানাঘাট-ডায়মন্ডহারবার-তিব্বত। আহা! যদি অবন ঠাকুরের হৃদয়ের মতও হতে পারতাম। ওদের পিঠে চড়ে দেশ বিদেশ দিব্বি ঘুরে নেওয়া যেত। পাসপোর্ট, ভিসার কোনো বালাই থাকত না। এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি ঝিরিঝিরি কুয়াশার জল আমার কম্বলটা কিছুটা ভিজিয়ে দিয়েছে ততক্ষনে। রাতশেষে কুটুরে প্যাঁচা গুলোও দুটো গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু এই পরিযায়ী পাখিদের কোন ক্লান্তি নেই। একটানা উড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই বুঝি ধাক্কা খাবে ঝাঁকগুলো একে ওপরের সাথে।

এভাবে অনেকক্ষণ চলার পরে আকাশটাও বেগুনি থেকে আস্তে আস্তে গোলাপি হয়ে এল। ঝাঁক গুলো আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কুয়াশা কাটছে একটু একটু করে। সকালের সোনালি রোদের ছটায় ওদের গায়ের রঙ গুলো আরও ভাল বোঝা যাচ্ছে। এবার কয়েকটা রাঙ্গামুড়ি হাঁসও উড়ে এল। ওদের মাথার লালমুকুটটাও ভালই বোঝা যাচ্ছে বাইনোকুলারে।



“আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর”

সত্যি কি যে এত কথা বলে ওরা। কতই না গল্প বুকে নিয়ে আসে। সেবার তাড়াহুড়োতে বাড়ি থেকে লেন্সটা আনা হয়নি।ছবি তোলা হল না। এত পাখি দেখতে পাবার আনন্দে ভুলেই গেছিলাম যে ব্যাগে আমার ক্যামেরাটা অন্তত আছে। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তুলবে কোন ক্যামেরা ?

বাগানের সামনের ঘাস গুলোতে এক দুটো লাইম ব্লু, গ্রাস ব্লু, কিউপিড, প্রজাপতি ডানায় শিশিরজল নিয়ে বসে, ওদের ডানার শিশিরগুলো ঠিক যেন হিরের মত চকচক করছে আলো পড়ে। ওদের ঠিক পাশেই কয়েকটা গোলাপি কাঞ্চনফুল আর মাধবীলতার ভেজা পাপড়ি লাল মোরামে আর সবুজ ঘাসে রঙ ছড়িয়েছে। এই বাগানের নীলমণি লতা, কমলাকান্ত, বনপুলকের কম চেনা গাছ ছাড়াও টগর, করবী, চন্দ্রমল্লিকার মত চেনা গাছে প্রচুর প্রজাপতিও আসে। শীতে একটু কম যদিও। ইতিমধ্যে সূর্য উঠেছে আর পরিযায়ী পাখিগুলো এবার জঙ্গলের দিকে যেতে শুরু করেছে। লেক গুলতেই বসবে ওরা।

কোন গভীর বন বা ন্যাশনাল পার্কের কথা না। রাজস্থানের ভরতপুর বা ওড়িশার মঙ্গলাজোরি, আসামের মাজুলি বা গুজরাটের কচ্চের রন নয়- এই বোলপুর –শান্তিনিকেতনেই আসত অনেক পাখি। কিছু বছর আগেও। অবিশ্বাস্যই বটে, সেদিন ভোরে আমিও নিজেকে কয়েকবার চিমটি কেটেছিলাম যে আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির সকালগুলো ওখানে এভাবেই শুরু হত আমার। এমনকি কিছু বার হেডেড গুস মধ্য এশিয়া থেকে কয়েকদিনের জন্য এখানকার ঝিলে এসে নেমেছিল। তাদের বেশি দেখা যায় কাছেই বক্রেশ্বর ড্যাম বা তিলপাড়া ব্যারেজে।

কলাভবনের ছাত্র হিসেবে প্রথম যখন এখানে এলাম আমার রুম ছিল বল্লভপুর অভয়ারণ্য সংলগ্ন এক বাড়িতে। তার কিছুদিনের মধ্যেই এই এলাকার আশেপাশের ঝিল, সাঁওতাল পাড়া আর লালবাঁধের প্রেমে পড়েছিলাম। বলাবাহুল্য, এখানকার গাছপালা আর প্রকৃতির বৈচিত্র্য চোখে পড়বার মত। বিশেষ করে শীতকালে আর বসন্তকালে। অবশ্য সব ঋতুতেই শান্তিনিকেতনের আলাদা সৌন্দর্য আছে যা আমার মত মফস্বল বা শহুরে মানুষকে মোহিত করবেই। রাঢ়ের শিমূল, পলাশ, মহুয়া ছাড়াও অমলতাস, নীলমণিলতা, অশোক, কুরচি, গুলঞ্চ, জারুল, জামরুল, চালতা, ফাগুনবউ, নানান অর্কিড আরো কত কি!

শান্তিনিকেতন গড়ে ওঠার সময় ও তার পরেও অনেক গাছ যেমন দক্ষিণপূর্ব এশিয়া আর আমেরিকা, মেক্সিকো ইত্যাদি নানা জায়গা থেকেও আনা হয়েছিল যা আগে সেভাবে দেখিনি।নন্দন হোস্টেলের পাশের মাটির রাস্তা ধরে গেলে লালবাঁধের দিকে উঠলেই ঝাঁক বেঁধে নানা পরিযায়ী পাখি দেখা যেত। অবৈজ্ঞানিকভাবে এলাকার চারধারের গুল্মজাতীয় গাছ আর শরবন কেটে ফেলায় গত তিন চার বছর ধরে আর তাদের দেখাই যায় না। তারা এর মাঝেই এরা ব্রিডিং করত বা খাবারটা সংগ্রহ করে নিত। এখন এর ইকোসিস্টেমটাই সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। এর মধ্যে গাডোয়েল, গারগ্নে, রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড, কমন কুট, ইউরেশিয়ান কুট, ফেরুজিনাস পোচার্ড, কটন পিগমি টিল, কমন টিল, সরাল ইত্যাদি নামত। শালুক পাতার ফাঁকে ফাঁকে ওরা চড়ে বেরাত। সকালে লাইব্রেরি যাবার আগে প্রায়দিন ওখানে গিয়ে নাম প্রেসেন্ট করে আসাটা আমার কাজ ছিল। ওরা যেন সদাব্যস্ত। দেখতাম জল মাকড়শার ব্যালে নাচ, নাকের পাশ দিয়ে কখনও বা ব্লু ফ্যান্টম, ক্লাবটেল বা ব্লু প্যাঞ্জি, পিয়েরট বা টনি কস্টার প্রজাপতি উড়ে গেল। জংলী ঝোপ আর পাতার নিচে ওদের ডিম পাড়ত। মাঝে মাঝে ক্যামেরা আনলে ছবিও তুলে রেখেছি বা ডায়েরিতে স্কেচ করেছি কিছু। তখন আনমনা লিটল গ্রিব কখনো কাছে এসে গেলে টুক করে ডুবে একটু দূরে গিয়ে উঠল। মাঝেমধ্যে দেখেছি স্নেকবার্ড গলা বার করে উঠে আছে বিশাল মাছ ঠোঁটে গেঁথে। এবার সেটা আস্ত মাছ গিলবে কিকরে এই নিয়ে এক বিড়ম্বনা তার। কখনো বা অসপ্রে এসে ছোঁ মেরে একটা বড় তেলাপিয়া বা রুই মাছ তুলে নিয়ে গেল। আর থাকত মুনিয়া, বার্ন সোয়ালো, আশি উড সোয়ালো, প্রিনিয়া, বাঘা ফটকা মাছরাঙ্গা ইত্যাদি।

বুধবার বা কোন ছুটিতে এই সময় কোনো দিন পাখি দেখতে সাথে আসত কিছু আর্টতুতো জুনিয়র ভাইবোনেরা বা শিক্ষাভবনের স্কলাররা। শিক্ষাভবনের হোস্টেলের ছাদে বসেও পাখি দেখার নেশা অনেকের মধ্যেই সংক্রামিত হয়েছিল। হরেক রকম বসন্তবৌরী, দোয়েল, ফিঙে, সোনাবউ, বেনে বউ, কাঠঠোকরা, হাঁড়িচাঁছা, কোকিল, শামুকখোল ইত্যাদি সাধারণ পাখি ছাড়াও বর্ষাকাল ও শরতে ইন্ডিয়ান পিট্টা, ইন্ডিয়ান প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার বা দুধরাজ, অরেঞ্জ থ্রাস, উলি নেকড স্টর্ক, ব্লাক হেডেড আইবিস ইত্যাদি দেখা যায়।

লালবাঁধের ধোপাদের কাছেই শুনেছি ঝিল গুলোতে নাকি অনেক বড় বড় মাছ আছে। তাই এখন নিয়মিত ভাবে পুকুরে মাছ ধরার বরাত দেওয়া চলে। কাজেই আর কোনদিন লালবাঁধে পরিযায়ী পাখিরা নাও আসতে পারে। এই বছরেও আসেনি।

এখানকার পুরোনো মানুষ ও আশ্রমিকদের মুখেও শুনেছি মাত্র ১৫-২০ বছর আগেও লালবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় এতপাখি আসত যে ওরা একসাথে উড়ে গেলে ওদের ডানায় লেগে থাকা জলের ছিটোতেই বৃষ্টির মত সারা গা ভিজে যেত। সাথে শুনেছি ঝিলের আর পুকুরে হাঁড়ি ভাসিয়ে পাখিদের অভ্যস্ত করিয়ে পরে কিভাবে চোরাশিকারীরা নিজের মাথাটা কোনো হাঁড়িতে লুকিয়ে থেকে পাখির পা ধরে। গুলতি মেরে, কাঠিতে আঠা লাগিয়ে, বিষ মাখানো ফড়িঙ দিয়ে বা জাল ফেলে পাখি শিকার নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছিল। চড়া দামে গোপনে হোটেলে চড়া দামে বিক্রিও হত বা হয় সেই সব ‘এক্সোটিক মিট’ বা পাখির মাংস। চোরাশিকারের দাপটে কিভাবে পাখি কমে গেল এই আক্ষেপ যেন বাল্মীকির সেই প্রথম শ্লোক বা শোকের মতই, যা আপনিই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে-

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ

(হে ব্যাধ তুমি অনন্তকাল শান্তি পাবে না কারন তুমি হত্যা করেছ প্রেমে মগ্ন পাখিযুগলকে)

ইউরোপ থেকে ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য বা মধ্য থেকে দক্ষিণ এশিয়া সর্বত্র এই শিকার পরম্পরা বা হান্টিং ট্রাডিশন মানব সভ্যতার এক কলঙ্ক ।

বোলপুরের অনেক পুরানো বাসিন্দাদের কাছেও শুনেছি যে ঝিল গুলির জল দূর থেকে আগে কালো দেখাত, এখানে এত পাখি আসত। এটা আমার দুর্ভাগ্য যে আমি এত পাখি দেখতে পাইনি ২০১৪ সালে। তবুও যা পেয়েছিলাম তাই ছিল প্রচুর আমার কাছে। পর দুই বছর আগেও এখানে লালবাঁধ সংলগ্ন মাঠের ও ঝিলের ঘাসজমিতে প্রায় ১০০-১৫০ টি কমন আর পিনটেল স্নাইপ থাকত। পায়ের সামনে দিয়ে উড়ে গেলেও এদের স্পট করা খুব কঠিন ছিল কারন এদের অসাধারণ কামোফ্লাজ বা লুকিয়ে থাকার ক্ষমতা। ঠিক যেন শুকনো ঘাসের চাদর গায়ে দেওয়া, এমনি তাদের প্যাটার্ন। কিন্তু ২০১৬ তে দেখলাম মাত্র দুইটি কি তিনটি আর এখন সেখানে গেলে নতুন কনস্ট্রাকশন দেখতে পাওয়া যাবে। এইরকমই দুটি মার্‌শ হ্যারিয়র আর একদল ক্রেস্টেড গ্রিব এসেছিল এই চত্বরেই যা আর গত দুই তিন বছরে এখানে দেখা যায়নি।

শিক্ষাভবন মোড় থেকে মাঠের পাশ দিয়ে ডিয়ার পার্ক হয়ে শ্যামবাটি যাবার জন্য এখন নতুন বড় রাস্তা হয়েছে। কাজেই পুরোনো সেই হ্যাবিটাট একেবারেই চরিত্রগত ভাবে পাল্টে গিয়েছে। বিস্তৃত চাষের ক্ষেত, বাগানগুলি, সিমেন্টের পোল আর কাঁটাতারে ঘিরতে শুরু করছে একে একে। গজিয়ে উঠেছে কংক্রিটের বিসদৃশ্য অট্টালিকা। বিগত কিছু দশক ধরে ধীরে ধীরে এভাবেই হারিয়ে গিয়েছে শান্তিনিকেতন। যথেচ্ছ পর্যটকের আনাগোনার সাথে এখন জুড়েছে পিকনিকের সময় ডিজে বক্স-এর তান্ডব। এর বিকট আওয়াজে পশুপাখি তো বটেই সুস্থ মানুষ নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। ইদানিংকালে শাল, সেগুন মেহগনির জঙ্গল সাফ করে বিকল্প রূপে সোনাঝুড়ি বা ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানোর যুক্তিগুলো একেবারেই দুর্বোধ্য। প্রকৃষ্ট বাসস্থানের অভাবে তাই এইসব এলাকাতেও পাখি প্রচুর কমে এসেছে।



আপনারা হয়ত জানবেন, শান্তিনিকেতনে বনবিভাগের আওতায় তিনটি বড় বড় ঝিল আছে। আগেই বলেছি এই পরিযায়ীরা সুদূর ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া থেকে আসে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে। আগের পাখিগুলো ছাড়াও নব্‌ ডাক (Knob duck), পার্পল মুর হেন, হানি বাজার্‌ড, কেস্ট্রেল, ইন্ডিয়ান স্পটেট ঈগল, শিকরা, গ্রে ফ্রাঙ্কোলিন, গ্রীন পিজিওন ছাড়াও নানান ফ্লাইক্যাচার, এমনকি ভেরডিটর ফ্লাইক্যাচার, স্কারলেট ব্যাকড ফ্লাওয়ার পিকার, উড শ্রাইক, ব্রাউন শ্রাইক, গ্রে ব্যাকড শ্রাইক, বুশচ্যাট, সাইবেরিয়ান স্টোনচ্যাট, গ্রে হেরন, পার্পল হেরন, ইয়েলো ওয়াটেল্ড আর গ্রে ল্যাপউইং, মোহনচূড়া, বাঁশপাতি, ফটিকজল বা আইওরা, নাঈটজা্র, ওরিয়েন্টাল হোয়াইট-আই, বিটার্ন ইত্যাদি দেখা যায়। দুই একবার অতি লাজুক পাখি কমন রেল ও বেলিয়নস ক্রেক ও দেখেছি এই লালবাঁধেই। একটু রাত হলেই রোজ আমার বাগানে স্কোপস আউল দুটো হুপ হুপ ডাকে জানান দেয় যে আমরাও দলে আছি।


এই সব ঝিলে কিছু দুর্লভ বাইকাল টিলও আসত যা ছিল প্রায় ৩৭৫০ কিলোমিটার দূরের রাশিয়ার বাইকাল লেকের বাসিন্দা। নিয়মিত ভাবে একসময় ই-বার্ড ও নানা বার্ডওয়াচিং সাইটে দিনে একশোর কাছাকাছি বা তার ওপরে স্পিসিস রেকর্ড করাও হত। সব মিলিয়ে তিনটি ঝিল মিলিয়ে প্রায় হাজারখানেক (১০-১৫ হাজার) পাখি তো বটেই শুধু এইটুকু জায়গাতে। নিঃসন্দেহে দক্ষিনবঙ্গের মধ্যে এটি একটি সবথেকে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর অঞ্চল। ঠিক যেন রাজস্থানের ভরতপুরের মতই সম্পন্ন অথচ জনচেতনার অভাবে উপেক্ষিত।


দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রচুর পরিমাণে জল দূষণ আর সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদাসিনতা বা দূরদৃষ্টি আর অর্থাভাব যেকোনো কারনে হোকনা কেন জলজ আগাছা আর পানাগুলি পরিষ্কার করার কাজ দূর অস্ত অনেকবার আবেদন করা সত্ত্বেও। পুরোটাই সেগুলি আগাছা আর পানায় ঢেকে ঘাসজমি বলে মনে হত। জল খুব কমই দেখা যাচ্ছে। ফলে এই ঝিলগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন। স্থান সঙ্কুচিত হবার ফলে পরিযায়ী পাখিরা নামার জন্য স্বচ্ছ জলটাই পাচ্ছেনা। যদিও এই বছর একটির ঝিলের কিছুটা সাফ করা হয়েছে দীর্ঘ লড়াই এর পর। পাখির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে প্রতিবছরে তবু সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা মানতে নারাজ।


পরিযায়ী পাখিরা এসে ফিরে যাচ্ছে অভয়ারণ্য ছেড়ে আশেপাশের অন্যকোনো বাসস্থানের সন্ধানে যা কিন্তু ওদের জন্য বিপদ আরও বেশী। তাছাড়া শান্তিনিকেতনের বাসিন্দারা প্রকৃতির এক অনন্য ঘটনা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন। এখানে নতুন কোনো বাসিন্দা বা পর্যটক আবার ঝিলগুলোকে ফুটবল খেলার মাঠ বা ধানক্ষেত বলে ভুল করতেই পারেন। আশা করব এর পরেরবার সেখানে গোলপোস্ট দেখতে হবেনা। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ঝিলগুলি পরিষ্কার করলেই একে বাঁচানো সম্ভব বা অন্তত কিছুটা রিস্টোর করা যেতেই পারে। কিভাবে পানা বা আগাছা সরানো উচিৎ বা কোন কোন গাছপালা রেখে কোনগুলোকে বাদ দিতে হবে সেটার জন্য বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীব ও পরিবেশ বিদ্যা নিয়ে নানা গবেষক ও অধ্যাপকেরা সে সম্পর্কে সম্যক প্রতিকারের পথ দেখাতেও সক্ষম।


এইগুলির সাথে প্রকৃতির সুক্ষ্ম কিছু ভারসাম্য জড়িয়ে আছে। কিছু পানা বা শরবন রাখতে হবে যাতে পাখিরা ডিম পাড়তে পারে বা রুস্টিং করতে পারে আবার শিকারি পাখি, সাপ, শিকারি পশু বা মানুষ থেকেও সুরক্ষিত থাকে। নিরাপদ নয় বুঝলে কিন্তু তারা আর সেই স্থানে আসবে না। দূষিত জল যাতে আর না মেশে তারও ব্যবস্থা করা দরকার নইলে আবার জলজ আগাছার স্তর জন্মাবে আর একই সমস্যা ফিরে ফিরে আসবে। জলে অক্সিজেন, pH লেভেল বা অন্য রাসায়নিক ভারসাম্যগুলি ঠিক আছে কিনা তাও খেয়াল রাখতে হবে।


মন দিয়ে শুনলে শীতের সন্ধ্যেবেলা বা ভোরের আকাশে খেয়াল করে এখনও ওদের ডাক শুনতে পাবেন। ওরা এখনও আমাদের ভরসা আর আশ্রয়েই এখানে আসছে। কারণ শীতকালে ওইসব দেশে মাইনাসে তাপমাত্রা! খাদ্য ও বাসস্থানের খোঁজে তাই ওরা দক্ষিণ এশিয়ার দিকে নেমে আসে কিছুদিনের জন্য। আবার এখানে ব্রিডিং করে তাদের ছানারা একটু বড় হলেই ফিরে যাবে সেই সব দেশে শীতকাল শেষ হলেই। আবার ফিরে আসবে পরের বছর ওদের নতুন প্রজন্মরা। যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলেই আসছে। এই পথে তারা যে নানান গাছের বীজ ফেলে যায় তা থেকে গাছপালা, জঙ্গল জন্ম নেয় প্রাকৃতিক উপায়ে বা পলিনেশনের কাজেও আসে ওরা নানাভাবে। কাজেই ধীরে ধীরে এরা না আসলে বা নানা কারনে কমতে থাকলে না থাকবে গাছ না থাকবে বৃষ্টি না থাকবে এই পরিবেশ আর না থাকব আমরা।


খুব গরম পড়লেই সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ইদানিং নতুন ট্রেন্ড চালু হয় 'গাছ লাগান'। বলা ভাল গাছ নয় বরং জঙ্গল লাগান। তাতে হয়ত কিছুটা সুরাহা হবে। অথচ সেই কাজটি প্রাকৃতিক ভাবে এই পাখিরাই তো করে।


দিন দিন পাখির সংখ্যা কমলেও সোশাল সাইটে গত কয়েক বছরে এক অদ্ভুত শ্রেণীর বার্ড ফটোগ্রাফারের সংখ্যা বেশ কয়েকগুণ বেড়েছে। এমনকি তাঁদের অনেকেই ছবি তোলার নামে পাখির বাসা বা হ্যাবিহাট নষ্ট করতেও পিছপা হন না। অথচ পরিবেশ সংক্রান্ত কাজে এগিয়ে আসাটা তাদের না-পসন্দ। যুক্তি এই যে, ঠিক পরিবেশবিদ নন তারা হলেন গিয়ে বন্যপ্রাণ ফটোগ্রাফার। 'লাইক' আর প্রাইজ পাওয়ার রেসারেসি ছাড়া আর পরিবেশের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা তাদের নেই। যে হারে পাখির ফটোগ্রাফারের সংখ্যা বেড়েছে, সেই হারে কিছুটা গ্রামে গ্রামে বা স্কুলে পরিবেশরক্ষা সংক্রান্ত সচেতনার কাজ সংঘবদ্ধভাবে হলেও তা আশাব্যঞ্জক হত। কিন্তু যা ঘটছে তা যেন এক উল্টোপুরাণ।


প্রাণের একমাত্র চিহ্ন এই নীলগ্রহটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এই রকমই অসংখ্য ছোট ছোট একেকটা ইকোসিস্টেম দিয়েই তৈরি। শান্তিনিকেতনের জঙ্গল সংলগ্ন ঝিলগুলিও তারই উদাহরণ। এই রকম অসংখ্য ছোট ছোট ইকোসিস্টেমের ইউনিট দিয়ে তৈরি পরিবেশ। আফ্রিকা, বোর্নিয়োর বর্ষাবন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া বা আমাজন পৃথিবীর প্রায় সবপ্রান্তেই এগুলি আজ কোনো না কোনো ভাবে বিপন্ন। শিল্পবিপ্লব ও উত্তর উপনিবেশ কালেও ধনতন্ত্র তার সংজ্ঞা বদলায়নি বরং স্বরূপ বদলেছে। পৃথিবীর সকল আদিবাসী জীবন ও পারম্পরিক জ্ঞানকে উপেক্ষা করে যন্ত্রসভ্যতার এই দাম্ভিক কুচকাওয়াজ আমাদের নিশ্চিত পতনের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।


পাখিরা জৈব কীটনাশকের কাজটাও অনেকটাই করে থাকে। পাখিরা না থাকার ফলে আমরাও ফলরূপে আরো রাসায়নিক কীটনাশক পদ্ধতি অবলম্বন করছি যা মাটির উর্বরতাকে নষ্ট করছে এবং পরে ভূগর্ভের জল বা পাশের নদী আর পুকুর কে বিষাক্ত করে তুলছে। জমি চাষের অযোগ্য হচ্ছে আর ধীরে ধীরে এইভাবে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে পুরো ইকোসিস্টেমটাই ভেঙ্গে পড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে, পাখিরা তাই প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ।


এই গত কয়েকবছর ধরে তো লালবাঁধ সংলগ্ন মাঠে বা কোপাই পাড়েও পিপিট, বাবুই, মোহনচূড়া বা শীতের বার্তাবাহক খঞ্জনাগুলিও খুবই কম। প্রায় নেই বললেও চলে। মাত্র কয়েক বছর আগের কথাই যেন এখন কয়েক যুগ অতীত বলে মনে হয়। জনমানসে প্রকৃতিপ্রেম, বিজ্ঞানমনস্কতা ও পরিবেশচেতনা গড়ে তোলা ছিল গুরুদেবের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। সৌন্দর্য্যের নিরন্তর সাধনার মাধ্যমেই সুস্থ ও সংবেদনশীল সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব এই ছিল তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়।


এখন শান্তিনিকেতনও এই চাষজমি হস্তান্তর বা দখল কোনোটা থেকেই মুক্ত নয়। প্রান্তিক বা কোপাই, গোয়ালপাড়া তালতোড় যেতেও বিলাসবহুল হোটেল, রিসোর্ট তার বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখি প্রায় প্রতিদিনই একটু একটু করে চরিত্র পাল্টে একটি মফস্বলে পরিণত হচ্ছে এটি। জঙ্গল সাফ হচ্ছে। এমনকি বসন্তউৎসবও আজ যেন পলাশ নিধন উৎসবে পরিণত। পলাশ ফুলের মালা হাতে বা খোঁপায় নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে থাকা কিছু টুরিস্টের দল সমাজের সেই অসংবেদনশীলতার চূড়ান্ত বিড়ম্বনাকেই দর্শাতে থাকে। শান্তিনিকেতনের সকল পরিবেশপ্রেমী বাসিন্দা ও পড়ুয়াদের কাছে অনুরোধ দেরী না করে জনমত ও জনশিক্ষার মাধ্যমে এই সকল বাস্তুতন্ত্রগুলিকে সংরক্ষন করার জন্য এগিয়ে আসুন নিজেদের স্বার্থে। আদিবাসী সমাজের পরিবেশ সংক্রান্ত পারম্পরিকজ্ঞান ও শ্রদ্ধা এইসব সমস্যার সমাধানেও খুবই প্রয়োজন। নইলে কেবলই স্মৃতিমন্থন ছাড়া কিছুই আর বাকী থাকবেনা।


গত কয়েক বছর ধরে নিশ্চয় অনেকেই টের পেয়েছেন কিভাবে আবহাওয়া খামখেয়ালি হয়ে উঠেছে। তাছাড়া ঈবোলা, সোয়াইন ফ্লু, জীকা বা SARS এর মতন নতুন নতুন অজানা মারণ ব্যাধির খবর তো প্রায় রোজই আমরা পাই। জীববিজ্ঞানী আর পরিবেশবিদরাও অশনি সঙ্কেতের ইঙ্গিত দিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য যে প্রকৃতিকে না মানলে মানুষ আদৌ টিকে থাকতে পারবেনা। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা আমাদের ক্রমশই প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমরা অসুস্থ হচ্ছি কংক্রীট নগরীর দূষিত পরিবেশে শারীরিক ও মানসিকভাবে। ভালবাসতেও ভুলে যাচ্ছি আমরা। দয়া, মায়া, প্রেম এইসব শব্দ অপ্রাসঙ্গিক আর ‘সেকেলে’ হয়ে পড়েছে যেন। তাই হিংসা, দ্বেষে মত্ত হাতির মত সভ্যতা ছুটে চলেছে এক অন্ধকার ভবিতব্যের দিকে।


এনথ্রোপসিন সময়কালে যথেচ্ছ শিকার বা অপরিণত মননের কৃষিব্যবস্থা বা শিল্প বা নগর প্ল্যানিং, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, অবাধ মাইনিং, অরণ্য ধ্বংস, প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামছাড়া চাহিদা, যথেচ্ছ প্লাস্টিক আর কেমিকাল সারের ব্যবহার, ফসিল ফুয়েলের প্রতি অতিনির্ভরশীলতা, নানান রকম দূষণ, আর সর্বোপরি মানুষের সীমাহীন লোভ আর অজ্ঞানতা এর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিও এই লোভকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। নীল গ্রহের প্রাকৃতিক সম্পদের সীমা থাকলেও মানুষের লোভের কোনো সীমা পরিসীমা তো নেই।


এই ইকোসিস্টেমগুলি আমাদের জন্যই তাসের ঘরের মত ভাঙতে শুরু করেছে। এখনও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। জৈব সার ও জৈব পদ্ধতিতে চাষ, গ্রীন এনার্জি, আকুয়াপোনিক্স, হাইড্রোপনিক্স, পারমাকালচার, প্রাকৃতিক বীজ সংরক্ষণ আন্দোলন ইত্যাদি বিকল্প জীবনবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে সফলতা পেয়েছে। তবুও সরকার ও জনমানসের এই ব্যাপক উদাসীনতা ভীষনভাবে উদ্বেগের সঞ্চার করে। কিন্তু এখনও সজাগ না হলে আর প্রকৃতিকে কাবু করার মনোবৃত্তি ছেড়ে সহাবস্থানের কথা না ভাবলে আমাদের ও আমাদের আগামি প্রজন্মের জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। প্রকৃতি অজেয়, তাই সে কিন্তু নিজের ভারসাম্য ঠিকই বজায় রাখবে। কখনো অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘন ঘন ট্রপিকাল স্টর্ম জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন বা হয়ত ভয়ানক মহামারী রূপে। আগামী প্রজন্ম কিন্তু তখন প্রশ্ন করবে – সুযোগ তো ছিল, তবে কেন তখন কিছু করেননি?- এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা কিন্তু খুব একটা সহজ হবে না।

Post a Comment

0 Comments