বিকল্প কি সত্যিই নেই ? Do alternative exists in this totalitirian world - A Thought By Sushovan Patra

Sushovan Patra এর লেখা।

অল্টারনেটিভ নেই। বিকল্প নেই। কেতাদুরস্ত স্টুডিও থেকে অর্ণব গোস্বামীরা ডিনারে বলে দিচ্ছে -বিকল্প নেই। সংবাদ মাধ্যমের সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং ব্রেকফাস্টে মনে করিয়ে দিচ্ছে  -বিকল্প নেই। প্যান্ডেমিকে মুড়ি মুড়কির মত মানুষ মরছে অথচ আপনি জানছেন -বিকল্প নেই। কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছেন অথচ আপনি শুনছেন -বিকল্প নেই। পরিযায়ী শ্রমিক ট্রেনে কাটা পড়ছে অথচ আপনি ভাবছেন -বিকল্প নেই। জিডিপি -২৩.৯%’র গোত্তা খাচ্ছে অথচ নাকি বিকল্প নেই। ‘তোরা ৭%, তোরা লোকসভায় শূন্য’, অতএব বিকল্প নেই। ‘তোদের সোভিয়েত ভেঙ্গে গেছে’, অতএব বিকল্প নেই। চন্দ্রবিন্দু বলেছে, ‘স্তালিন ছিল ধূর্ত/৬টা ডামি নিয়ে ঘুরতো’ অতএব স্তালিনে বিকল্প নেই। 
স্তালিন যদি ধূর্ত, ধোয়া তুলসী পাতাটা কে? হিটলার? মুসোলিনি? ফ্রাঙ্কো? না পিনোচে? উত্তর খোঁজার প্রয়োজনই নেই! নেই কারণ আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘বিকল্প নেই। মাইন কাম্ফে হিটলার লিখছেন ‘কমিউনিস্টদের উৎখাত করা ছাড়া জার্মানির উন্নতির বিকল্প নেই’। ফ্যাসিস্ট পার্টির মুখপত্র, Il Popolo d'Italia-র সাক্ষাৎকারে মুসোলিনি বলছেন ‘কমিউনিস্টদের মাথা ভেঙ্গে সরকার আর কর্পোরেটদের হাত মেলানো ছাড়া ইতালির কাছে বিকল্প নেই।’ মিলিটারি ক্যুয়ের পর ফ্রাঙ্কো বলছেন, ‘আমি থাকতে স্পেনে কমিউনিস্টদের জায়গা নেই। আর আমি ছাড়া স্পেনের কোন বিকল্প নেই’। ভিক্টর জারার আঙুল থেঁতলে দিয়ে পিনোচে বলছেন ‘কমিউনিজমের চিতা সাজানো ছাড়া চিলির কোন বিকল্প নেই।’   
সময় বদলেছে, কমিউনিজমের ভূত দেখানো বন্ধ হয়নি। ‘বিকল্প নেই’ বলা থামেনি। ১৯৮৬, রোনাল্ড রেগানের ‘9 Most Terrifying Words’, অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ ছাড়া বিকল্প নেই’। ১৯৮৯, মার্গারেট থ্যাচারের TINA (There is no alternative), অর্থাৎ ‘ক্যাপিটালিজমের কোন বিকল্প নেই’। কিম্বা ১৯৯১, নরসিমা সরকারের অক্সফোর্ড ফেরত অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, দেশের বাজার কে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে, উদারীকরণ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।’ 
মনমোহন সিং-র হাত ধরে এদেশে যেদিন বেসরকারিকরণ-বিলগ্নিকরণের বল্গাহীন তুরঙ্গে নিও-লিবারেলিজমের অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটানো শুরু হয়েছিল, তেন্ডুলকার তখনও ODI-এ প্রথম সেঞ্চুরি করেননি, আদবানি তখনও ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে-র’ চ্যাংড়ামি শুরু করেননি, নেপোটিজেমের বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালতে আলিয়া তখনও ভাট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি, ইয়াসির আরাফাত তখনও স্বাধীন প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নটা কনসেপ্টটাই তখনও প্যায়দা হয়নি। আজ সেই নিও-লিবারেল অর্থনীতির প্রায় ৩০বছর পর কি পেয়েছেন আপনি? কেমন আছেন আপনি? 
২০২০-র অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, ভারতের ধনীতম ১% মানুষের মোট সম্পত্তি দরিদ্রতম ৭০%-র মোট সম্পদের ৪ গুনের বেশি।  স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে যে দেশে মোট বিলিয়নারির সংখ্যা ছিল ৯, শেষ কুড়ি বছরে সেই দেশেই বিলিয়নারির সংখ্যাটা ১৩৮। যে ১৩৮ জন বিলিয়নারির মোট সম্পদ ২০১৮-১৯’র কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত বাজেটের থেকে বেশি। আর অন্যদিকে প্রতিবছর ৬.৩কোটি মানুষ নতুন করে তলিয়ে যাচ্ছেন গরিবির অতলস্পর্শী অন্ধকারে। প্রতি সেকেন্ডে দুজন। 
বিজ্ঞাপনে বলে, पहले इस्तेमाल करें फिर विश्वास करे। তাই অক্সফাম ছাড়ুন সরকারী তথ্য দেখুন। ৪৫বছরের সর্বোচ্চ বেকারত্ব কিম্বা পেট্রোল-ডিজেলের ঐতিহাসিক মূল্য বৃদ্ধি -আমাদের গণ্ডারের চামড়ায় এসব গা-সওয়া। তাই অপরিকল্পিত লকডাউনে প্রধানমন্ত্রীর মুখে যত্ন করে রাখা ব্যান্ডলজ দাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অর্ধাহারে-অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা, প্রায় ৫০০। কাজ হারিয়েছেন ২০কোটি মানুষ। অর্থনীতির ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে থাকা এই বিন্দু গুলো জুড়েই ভয়ঙ্কর নকশাটা এঁকেছে ২০২০-র প্রথম কোয়ার্টার। জিডিপির ২৩.৯% সংকোচন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এসবই নাকি ‘Act of God’ –ভগবানের ইচ্ছে। আর ভগবান কে দোষ দেবে কার বাপের সাধ্যি? অতএব, ব্যাক টু জিরো, Act of God তাই কোন বিকল্প নেই। 
ধনী আরও ধনী হবে আর গরীব আরও গরীব -বিকল্প নেই। ঋণের দায়ে কৃষক গলায় দড়ি দেবে -বিকল্প নেই। শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি না পেয়ে অনাহারে মরবে -বিকল্প নেই। শিক্ষা-স্বাস্থ্য হাটে-বাজারে বিক্রি হবে -বিকল্প নেই। ধর্মের নামে মানুষ লেলিয়ে দেশ বেচা হবে -বিকল্প নেই। মামুলি ধনে পাতার ৫০০ টাকা/কেজি দর উঠবে -বিকল্প নেই। যে কোয়ার্টারে দেশের জিডিপি ২৩.৯% সংকুচিত হবে, সেই কোয়ার্টারেই মুকেশ আম্বানির সম্পত্তি ৩৫% বাড়বে -বিকল্প নেই। প্যান্ডেমিকে প্রধানমন্ত্রী ময়ূরের সাথে ফটো শুট করবেন কারণ, সিম্পল, -বিকল্প নেই। আপনি প্লিজ বিশ্বাস করুন, নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প নেই। বাজার অর্থনীতির বিকল্প নেই। ক্যাপিটালিজমের বিকল্প নেই। 
কারণ আপনি এগুলো বিশ্বাস না করলে ক্যাপিটালিজমের দালালদের বিপদ। ফ্যাসিজিমের পোস্টার-বয়দের বিপদ। বিকল্প যে আছে এটা আপনি বুঝতে পারলে, বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করলে, বিকল্পের দাবী তে লড়াই করলে বিপদ। কারণ হিটলার-থ্যাচার কিম্বা মোদী সবাই জানে বিকল্প তো আছে। বহাল তবিয়তেই আছে। আপনার চারপাশেই আছে।
বেসরকারিকরণ আর বিলগ্নিকরণের বিপক্ষে দেশেই ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, রেলের জাতীয়করণ কিম্বা নবরত্নের সাফল্যের বিকল্প আছে। ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণের প্রবণতার বিপ্রতীপে রাজ্যেই ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প আছে। অর্থনীতির উন্নতির নামে কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড় দেওয়ার বদলে MNREGA-য় দেশের প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকার সমস্যার নিরসনের বিকল্প আছে। কৃষক আত্মহত্যার অন্য পিঠে অপারেশন বর্গার বিকল্প আছে। মন্দির-মসজিদ-স্ট্যাচু না বানিয়ে শিক্ষা খাতে সরকারী বরাদ্দ বাড়ানোর বিকল্প আছে। করোনা মোকাবিলায় উন্নত সরকারী স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার বিকল্প আছে। ক্যাপিটালিজমের আঁতুড়ঘর আমেরিকাতেই ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্যান্ডেমিকের বাজারে চাহিদা তৈরির বিকল্প আছে। ধনীতম ১০% ব্যক্তির সম্পদে মাত্র ২% সম্পদ কর বসিয়ে গরীবের মুশকিল আসানের বিকল্প আছে। 
আর বিকল্প যদি নাই থাকে, তাহলে ক্যাপিটালিজমের দালালদের ‘বিকল্প নেই’ প্রমাণ করতে প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে কেন? ফ্যাসিজিমের পোস্টার-বয়দের ১০০ বছর ধরে ‘কমিউনিজম মৃত’- ঘোষণা করতে হচ্ছে কেন? ক্যাপিটালিজমই যদি সর্বশ্রেষ্ঠ তাহলে প্যান্ডেমিকে ক্যাপিটালিস্ট দেশ গুলোরই প্যান্টালুন হলুদ হয়ে যাচ্ছে কেন? 
নরেন্দ্র মোদী তো শুনেছি দিন কে রাত করতে পারেন। মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানাতে পারেন। ৩৭%-র জনমত আছে, লোকসভা তে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, রাজ্যসভাতে দাপট আছে, জুডিসিয়ারি ম্যানেজ আছে, ফেসবুকে আঁতাত আছে, বেডরুমে আড়ি পাতা স্বভাব আছে, পা-চাটা মিডিয়া আছে। কই এতো কিছু নিয়েও তো অর্থনীতি বিশল্যকরণী খুঁজে দেবার মুরোদ নেই তো। ধর্মের বুলি কপচে সব পেটে ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই তো। মুক্ত বাজারে হিন্দু-মুসলমানের ক্যালোরির আলাদা হিসাব করার মুরোদ নেই তো। মুনাফা তে ব্রাহ্মণ-দলিত'র ‘উদ্বৃত্ত শ্রমের’ বাছাই করার মুরোদ নেই তো। 
মুরোদ নেই, আর মুরোদ হবেও না। কারণ বাস্তব এটাই যে শ্রমের শোষণেই পৃথিবী জোড়া সম্পদের এই প্রবল বৈষম্য। বাস্তব এটাই যে ক্যাপিটালিজমে নয়; দাড়ি বুড়োর ‘দাস ক্যাপিটাল’ই বন্দী আছে অর্থনীতির সাম্য।

Post a Comment

0 Comments