আকবর কি বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা ? না রাজা শশাঙ্ক ? বাংলা নবর্ষের উৎস সন্ধানে । The Origin of Bengali New Year - Poila Baisakh

Bengali New Year - Poila Baishakh



ইদানিং ভারতবষর্ষে শিক্ষা সংস্কৃতির যে গৌরীকারণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার বিপরীতধারায় দেখা যাচ্ছে প্রথাগত রীতি রেওয়াজের ইসলামীকরণ; যেমন এই নববর্ষের প্রাক্কালে একটি  বিজ্ঞাপন দেখে  জানতে পারলাম - পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষের সূচনা  সম্রাট আকবরের হাত ধরে ! সত্যি কি তাই ? সুদূর দিল্লিতে বসে হটাৎ কি মনে করে আকবর শুরু করলেন - "ফসলঃ ইশান"  যা কিনা আজ "পয়লা বৈশাখ ". আত্মবিস্মৃত জাত বাঙালী আজ আধ খাওয়া আপেল ও গুগলনির্ভর ; দেখে নেওয়া যাক পয়লা বৈশাখের আসল সূচনা । স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী-র কলমে


বঙ্গাব্দের সূচনা ও  মোগল বাদশা আকবর ।এই মতটা বহুদিন ধরেই মূলধারায় আসার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশি মুসলমানদের একটা অংশ এই মতের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেও এপার বাংলায় এর মূল মদতদাতা হলেন কতিপয় গুগলনির্ভর বুদ্ধিজীবীরা। এবং অবশ্যই নিজের ইতিহাস না জানা বাঙালি নিজস্ব নববর্ষের এই বিকৃত ইতিহাসই সাদরে গ্রহণ করছে।

বাঙালির লিখিত ইতিহাস না থাকা এবং যেটুকু আছে, সেটুকুও অনলাইনে খুব একটা সহজলভ্য না হওয়াতেই বাঙালির মনে নিজের ইতিহাস নিয়ে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। এই শূন্যস্থানের সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাইছে "আকবর_বঙ্গাব্দের_প্রতিষ্ঠাতা" তত্ত্ব। 





সৃজন রিয়ালিটি - বিজ্ঞাপন । যেখানে হচ্ছে শশাঙ্ক কে ভুলে গিয়ে আকবরকে বলা হচ্ছে পয়লাবৈশাখের সৃষ্টিকর্তা। #totalbhulbhal 



বঙ্গাব্দ যে আকবর চালু করেননি, এটা ধরতে পারার জন্য কোন বড় ইতিহাসবিদ হতে হয় না। বোধশক্তির সামান্য প্রয়োগ করলেই এই কাণ্ডজ্ঞানহীন মিথ্যার পাঁচিল হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়বে। বঙ্গাব্দ অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হয় পয়লা বৈশাখ। এই পয়লা বৈশাখ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে কখনো ইংরেজির ১৪ই এপ্রিল আবার কখনো পড়ে ইংরেজির ১৫ই এপ্রিল।  এই একই সময়ে ভারতের আরো বিভিন্ন রাজ্যে নববর্ষের উৎসব পালিত হয়। কেরালাতে যার নাম বিশু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, পাঞ্জাবে বৈশাখী, কামরূপে (বর্তমান নাম- আসাম) ভাস্করাব্দ শুরুর উৎসবে পালিত হয় রঙালী বিহু, ত্রিপুরার উপজাতিদের মধ্যে বৈসাগু ইত্যাদি।

তো এখন প্রশ্ন হল, ভারতের এতরকম জাতির নববর্ষ একই সময়ে প্রায় একই দিনে পড়ছে কিভাবে যদি আকবর কেবলমাত্র বঙ্গাব্দ টুকুই চালু করে থাকেন? এবং আরো প্রশ্ন হল, আকবরের রাজধানী দিল্লির কাছেই পাঞ্জাব। অথচ পাঞ্জাবের বৈশাখী-র প্রচলন করেন আকবর, এমন কোন মত প্রচলিত নেই। তাহলে মোগল বাদশা আকবর ঘরের পাশে পাঞ্জাবে বৈশাখী চালু না করে উত্তর ভারত, মধ্য ভারত পেরিয়ে সোজা বাংলায় এসে বঙ্গাব্দ চালু করলেন কেন? দিল্লির আশেপাশের অঞ্চল দিয়ে শুরু করলেন না কেন?

আরো মজার ব্যাপার হল দিল্লি এবং তৎসংলগ্ন উত্তর ভারত এবং মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় বর্ষপঞ্জি হিসেবে বিক্রম সম্বত বা বিক্রমাব্দের ব্যবহার রয়েছে। তা যিনি গোটা ভারতের বাদশা, তিনি সারা ভারতে এক বর্ষপঞ্জি চালু না করে শুধুমাত্র বাংলাতেই কেন আলাদা একটা বঙ্গাব্দ চালু করতে গেলেন? বাকি ভারতে কেন নয়? কারণ যে কোন রাজা যখন কোন নতুন বর্ষপঞ্জি চালু করবেন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই গোটা রাজত্বে একই বর্ষপঞ্জি চালু করবেন। অতএব, নিজের রাজত্বের বাকি অংশের জন্য আকবর রাখলেন একরকম বর্ষপঞ্জি, আর শুধু বাংলার জন্য বানিয়ে দিলেন বঙ্গাব্দ- এটা মারাত্মক রকম কষ্টকল্পনা হয়ে যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় রাজা বিক্রমাদিত্যের কথা। বিশাল ছিল তার রাজত্বের পরিসীমা। ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অংশ হয়ে এমনকি ইউরোপের কিছু অংশে পৌঁছে গেছিল তাঁর শাসনের সীমা। তবে তাঁর সম্পুর্ন রাজত্বের জন্য তিনি প্রচলন করেন একটিই বর্ষপঞ্জি, যার নাম বিক্রম সম্বত।

মল্লরাজ আদিমল্ল তাঁর গোটা রাজত্বের জন্য চালু করেন মল্লাব্দ। কামরূপ রাজ ভাস্কর্বর্মন তাঁর গোটা রাজত্বের জন্য যে বর্ষপঞ্জি চালু করেন, তার নাম ভাস্করাব্দ। তাহলে আকবর ব্যতিক্রম হবেন কেন? কারণ নিজের রাজত্বের একেক জায়গায় একেক রকম বর্ষপঞ্জি চালু থাকলে তো রাজকর্মচারীদের পক্ষেও দিন গণনা করা মুশকিল হয়ে উঠবে। এই প্রশ্নগুলো মনে এলেই "আকবর বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন"-এর ভিত দুর্বল হতে শুরু করে। কারণ এসব প্রশ্নের কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর, "আকবর_বঙ্গাব্দের_প্রতিষ্ঠাতা" তত্ত্বের তাত্ত্বিকরা এখনো বানিয়ে উঠতে পারেননি। 

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, আকবর সত্যিই এক নতুন বর্ষপঞ্জি চালু করেন। যার কথা আকবরের সমসাময়িক জীবনী এবং ঐতিহাসিকদের লেখায় রয়েছে। তবে সেই বর্ষপঞ্জির নাম "তারিখ-ই-ইলাহী"! সেই বর্ষপঞ্জির সাথে এবং তার গণনাপদ্ধতির সাথে বঙ্গাব্দের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই এবং কনামাত্রও মিল নেই। এমনকি আকবরের কোন জীবনীতে এমন কোন তথ্য প্রমাণের উল্লেখ নেই যে আকবর তার রাজত্বের বাকি অংশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বাংলার জন্য  একটা আলাদা বর্ষপঞ্জি গঠন করেন, যার নাম বঙ্গাব্দ। আকবর নিজেও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি, যে তার মৃত্যুর কয়েক শতক পর তার রাজত্বের এক প্রান্তিক কোনের নববর্ষ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তিনি পেয়ে যাবেন। আর সেজন্যই আইন-ই-আকবরী'র রচয়িতারাও আকবরের বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার প্রমান তো দূরের কথা, উল্লেখ মাত্র এসব বইতে রেখে যাননি। শুধু সেটুকুই নয়, বাংলায় এবং কামরূপের বহু প্রাচীন মন্দিরের গায়ে এবং তাম্রলিপিতে এমন বঙ্গাব্দের উল্লেখ আছে, যেটা আকবরের সিংহাসনে বসার বহু আগের। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মৃন্ময়ী মাতার মন্দির ৪০৪ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত। এই মন্দির শুধু আকবর নয়, বখতিয়ার খিলজিরও আগমনের আগে প্রতিষ্ঠিত। আকবর যদি বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হন, তাহলে আকবরের বহু শতাব্দী আগের মন্দির গাত্রে এবং তাম্রলিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ কোত্থেকে এল? 

তবে এসব বাধা "আকবর_বঙ্গাব্দের_প্রতিষ্ঠাতা"-র তাত্ত্বিকদের টলাতে পারেনি। তাদের মতানুযায়ী আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসার পরই বঙ্গাব্দ চালু হয়। এই মতের মুশকিল হল, আকবর সিংহাসনে বসেন ইংরেজি 1556 সালে।
তার রাজত্ব চলেছিল 1605 সাল অব্দি। বর্তমানে চলছে ইংরেজি 2019 সাল। যদি ধরে নিই আকবর 1556 সালেই বঙ্গাব্দ চালু করেন, তাহলে ইংরেজি 1556 সাল হওয়া উচিত 0 বঙ্গাব্দ এবং ইংরেজি 1557 সাল হওয়া উচিত বঙ্গাব্দ-১। 
সেক্ষেত্রে ইংরেজি 2019 সাল হওয়া উচিত 2019-1556= 563 বঙ্গাব্দ। 
অথচ আমরা সকলেই জানি 2019 সালের 15ই এপ্রিল পালিত হবে ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। তাহলে আকবর বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা করলে,  প্রায় হাজার বছরের পার্থক্য আসছে কিভাবে? তখন "আকবর_বঙ্গাব্দের_প্রতিষ্ঠাতা"-র তাত্ত্বিকরা সব দলে দলে মাথা চুলকাতে লাগলেন। হিসেবের এত বড় গোঁজামিল তারা মেলাবেন কিভাবে? তখন তারা নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিলেন। তাঁরা বললেন, মোগল বাদশা আকবর নাকি বঙ্গাব্দ প্রচলন করেন ইসলাম ধর্মের আরব্য নবী হজরত মহম্মদের হিজরত-এর বছর অনুসারে। হজরত মহম্মদ মদিনা থেকে মক্কার দিকে হিজরত করেন ইংরেজি 622 খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ 622 খ্রিস্টাব্দকে শূন্য বঙ্গাব্দ এবং 623 বঙ্গাব্দকে বঙ্গাব্দ-১ ধরে আকবর বছর গণনা চালু করেন। তাহলে আমরা যদি হিসেব করি, তাহলে এই বছর হওয়া উচিত 2019-622= 1397 বঙ্গাব্দ। অথচ এটা ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। তাহলে প্রায় তিরিশ বছরের পার্থক্য এল কিভাবে?

Origin of Poila Baisakh


এবং আরো প্রশ্ন হল, হিজরত দিয়েই যদি আকবর বঙ্গাব্দ গণনা শুরু করতে চান, তাহলে বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতি হিন্দু সূর্যসিদ্ধান্ত মতে কিভাবে হল? যিনি হিজরতের মত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে আস্ত বঙ্গাব্দ চালু করলেন, সেই বঙ্গাব্দের গণনাপদ্ধতির সাথে ইসলামী হিজরী বর্ষপঞ্জির কিছু সঙ্গতি থাকা উচিত। শুধু তাইই নয়, বঙ্গাব্দের মাসের নাম বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ এবং বারের নাম সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ইত্যাদি কিভাবে হতে পারে? এই সমস্ত মাসের নাম এবং বারের নাম  সারা ভারতের প্রায় সমস্ত হিন্দু বর্ষপঞ্জিতেই এক। 


হিজরত অনুসারে এ কেমন বর্ষপঞ্জি চালু করলেন আকবর, যার গণনাপদ্ধতি চান্দ্রমাস অনুসারে হল না, বারের নাম শুক্র-শনি থেকে জুম্মা-আল সাবাত হল না। মাসের নামও বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য থেকে মাহে রমজান-রবিউল আওয়াল ইত্যাদি হল না। বঙ্গাব্দের সমস্ত কিছুই যে ভারতের অন্যান্য হিন্দু বর্ষপঞ্জির মতোই রইল, যার জাজ্জ্বল্যমান প্রমান এই একই সময়ে তামিল নববর্ষ পুথান্দু থেকে মালোয়ালি নববর্ষ বিশু, কামরূপের নববর্ষ ভাস্করাব্দ ইত্যাদি পড়া। গণনা পদ্ধতি একই রকম না হলে তো আর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের এতগুলো হিন্দু নববর্ষ এই একই সময়ে পড়তে পারে না।  তাহলে, এ কেমন নতুন বঙ্গাব্দ চালু করলেন আকবর, যার কোনকিছুই বাকি ভারতের অন্যান্য হিন্দু বর্ষপঞ্জির থেকে আলাদা হল না, সবটুকুই একই রয়ে গেল? কিছু যদি নাই পাল্টায় তাহলে আলাদা বর্ষপঞ্জি তৈরির মানে কি?

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গোঁজামিল ইতিহাস দিয়ে সহজ সরল অঙ্কের হিসেব বা যুক্তির হিসেব, কোনটাই মিলছে না। তাহলে আসল সত্যি কি? কে করলেন বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা? এর উত্তর দিতে গিয়ে আমরা আবার অঙ্কের হিসেবে ফিরে যাব। এতক্ষনে এই ব্যাপারটুকু নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়ে গেছে, যে ইংরেজি বছর এবং বাংলা বছরের মধ্যে অনেক বছরের ফারাক আছে। সেটা কত বছর? 2019-1426 করলে পাই 593 সাল। অর্থাৎ বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু হয় 593 সাল নাগাদ। এই সময়ে এমন কেউ বাংলার সিংহাসনে বসেন, যিনি এই বর্ষপঞ্জি চালু করেন।  ইতিহাস বলছে, ওই বছরই বহু খণ্ডে বিভক্ত বাংলাকে একত্রিত করে সিংহাসনে বসেন মহারাজ নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্ক। মহারাজ শশাঙ্ক ছিলেন ঘোর শৈব, তাই শৈবদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার সোমবারে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। হিসেব করলে দেখা যায়, প্রথম বঙ্গাব্দের শুরুর দিনটিও ছিল সোমবার।

"আকবর_বঙ্গাব্দের_প্রতিষ্ঠাতা", এই মতের প্রধান প্রবক্তা হলেন বাংলাদেশের শামসুজ্জামান খান, সৈয়দ আশরাফ আলী, সিরাজুল ইসলাম, আহমেদ জামাল ইত্যাদিরা। এনাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার আকবরকে বাদ দিয়ে আলাউদ্দিন হুসেন শা-কে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত দিয়েছেন। এখানে মনে রাখা দরকার হুসেন শাহের রাজত্বকাল ইংরেজি 1494 থেকে ইংরেজির 1519 সাল অব্দি। ইনি বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হলে বঙ্গাব্দের বয়স 500 বছরের বেশি হবে না। তাহলে কেন বাংলাদেশের মুসলমান ঐতিহাসিকরা বারেবারে এরকম অবাস্তব দাবি তুলছেন? কেন তারা বাংলার ভূমিপুত্র নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্ক-কে বাদ দিয়ে বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার সম্মান তুলে দিতে চান অবাঙালি আকবর কিংবা বহিরাগত হুসেন শাহ-এর হাতে? আকবর বা হুসেন শা আসার আগে, বাঙালির এতকাল যাবৎ চাষবাস, পূজার্চনা ইত্যাদি কিভাবে, কোন বর্ষপঞ্জি মতে সম্পন্ন হচ্ছিল? যেখানে বাংলায় আকবরের বহু শতাব্দী আগে থেকেই নানান বর্ষপঞ্জি প্রচলিত। মল্লাব্দ, বুদ্ধাব্দ, বঙ্গাব্দ, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি সম্পুর্নভাবেই বাঙালির সৃষ্ট বর্ষপঞ্জি।

বাঙালিকে কৃতিত্ব দিতে কিসের এত অনীহা বাংলাদেশের শামসুজ্জামান-সিরাজুল-আহমেদ জামালদের? যে বাঙালি জাতির বয়স পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি, নিজেদের জন্য সামান্য একটা বর্ষপঞ্জিও কি তারা তৈরি করতে পারবে না? যে সেটা মোগল-পাঠান বাদশাদের এসে তৈরি করে দিয়ে যেতে হবে? 


একটু তলিয়ে ভাবলেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিকদের আকবর বা হুসেন শা-কে বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে দেবার মরিয়া চেষ্টার কারণটা বোঝা যায়। খুব বেশি দশক আগের কথা নয়, যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ বাঙালির চিরাচরিত বর্ষ গণনা পদ্ধতিকে উল্টেপাল্টে একটি নতুন কৃত্রিম বর্ষগণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করে সেটিরও নাম রাখেন বঙ্গাব্দ। এবং এই কৃত্রিম বঙ্গাব্দকে "বাংলাদেশের জাতীয় বর্ষপঞ্জি" হিসেবে ঘোষণা করেন।

এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা 92 ভাগ মুসলমান, যাদের প্রধান উৎসব হল ঈদ, মহরম ইত্যাদি। এখন বাংলাদেশে কি এই ঈদ, মহরম এরশাদ রচিত কৃত্রিম বঙ্গাব্দ অনুসারে গণনা হয়? উত্তর হল- না। বাংলাদেশে ঈদ, মহরম ইত্যাদি সবই হিজরী গণনা পদ্ধতি অনুসারে হয়। তাহলে কি কারণে এরশাদ বঙ্গাব্দ-র গণনাপদ্ধতি পাল্টে দিলেন? বঙ্গাব্দ অনুসারে পূজা-পার্বন গণনা করেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। তবে কি তাদের পূজা-পদ্ধতিতে ব্যাঘাত ঘটানোর উদ্দেশ্যেই "বঙ্গাব্দ সংস্কার"-এর নামে জেনারেল এরশাদের এই #নববর্ষ_দখল এর প্রচেষ্টা? আর সেই প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই কি বাংলাদেশের সিরাজুল-আশরাফ আলী-শামসুজ্জামানরা যেন-তেন-প্রকারেন বঙ্গাব্দের ইতিহাস থেকে বাঙালির নামগন্ধটুকু মুছে দিতে চান? বঙ্গাব্দ থাকবে, কিন্তু তার গণনাপদ্ধতি পাল্টে দেওয়া হবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, বঙ্গাব্দ থাকবে কিন্তু তার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে থাকবে কোন মোগল-পাঠানের নাম। তবেই তো বাঙালির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে তার নববর্ষ। নববর্ষ দখল সম্পুর্ন হলে বাঙালির কাছ থেকে বাংলাদেশের গ্রাসে যাবে বাঙালির এক অমূল্য ইতিহাস। 

তাই বাঙালিকে সবসময় সজাগ থাকতে হবে #সাংস্কৃতিক_আগ্রাসন এর বিরুদ্ধে। আমাদের নববর্ষ, আমাদের সংস্কৃতির অমূল্য অংশ। বাঙালির লিখিত ইতিহাস চাই, বাঙালির ইতিহাস খুব সহজলভ্য হওয়া চাই। যে জাতির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যত দুর্লভ হয়, সেই জাতির ইতিহাস বেদখল হবার সুযোগ তত বাড়ে।

উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। নিজের নববর্ষের প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে বাঙালির অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে আকবরকে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বানাতে চায় কিছু সাংস্কৃতিক আগ্রাসী। এই আগ্রাসন ঠেকাতে চাই নিজের ইতিহাস সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান। এবং সেই জ্ঞানের ক্রমাগত স্মরণ।

ভুলে যাবেন না, কোন বিদেশী বাদশা আকবর নন, বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বাংলার ভূমিপুত্র রাজা শশাঙ্ক। এই ভয়ানক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের দিনে, যখন মিডিয়ায়, ওয়েবসাইটে, খবরে, ভিডিওয় ক্রমাগত মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বঙ্গাব্দের নামে, তখন বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা শশাঙ্কের নাম মনে রাখা এবং এই তথ্যটিকে সমস্ত চেনা পরিচিতের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াটাই হল বাঙালির "সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ"। এই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অঙ্গীকার দিয়েই শুরু হোক নববর্ষ ১৪২৬।


আকবর কি বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা ? না রাজা শশাঙ্ক ? বাংলা নবর্ষের উৎস সন্ধানে । The Origin of  Bengali New Year - Poila Baisakh 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : https://fourlimbed.blogspot.com/2019/04/blog-post_15.html

Post a Comment

2 Comments

  1. IT IS POSSIBLE TO CONTINUE SASANKA'S BANGABDA . IT WAS REWRITTEN BY DELAYING 14 DAYS OF VIKRAM SAMBAT COMPARING IN ORDER OF HIJRI YEAR.

    ReplyDelete
  2. It is possible Bangabda being commenced by delaying the Vikram Sambat year by 14/15 days of chaitra to honour Hizri year during Akbar regime

    ReplyDelete