প্রতি লিটার শীতল পানীয় বানাতে ৮ লিটার জল লাগে। মানে ৭ লিটার জল পুরো বরবাদ | মানে একটা ছোট্ট দোকানে যদি ২০ লিটার কোক বা থামস আপ থাকে, তাহলে ১৪০ লিটার জল স্রেফ নেই হয়ে গেছে।

Water Scarcity

কিছু মানুষ সর্বদাই থাকেন, যারা ঘোরতর সাম্যে বিশ্বাসী। ঠাকুরঘরের কলা চুরি করল হারু। আর তারা তার দায়ভাগ অকাতরে চাপিয়ে দেন সকলের উপর। হারু তো চুরি করে খালাস। তা বাকিরা মুখ বুঁজে চুরিটা করতে দিল কেন? কাজেই তারাও দোষী। সাম্প্রতিক ভারতের জলকষ্ট নিয়ে লিখলেন : সুজন ভট্টাচার্য


হারুর বাবা কেন একটামাত্র কলা কিনে এনেছিল? মাথা গুনে গুনে আনলে হারুর নিশ্চয়ই চুরি করার সাধ হত না। সবথেকে বড় কথা, কলাটা ঠাকুরঘরেই কেন যাবে? হারুর মায়ের এই পুজোআর্চার বাতিকের জন্যই কেবল ঠাকুরের নামেই কলা এসেছিল। অতএব গোটা বাড়িই চুরির দায়ে দুষ্ট। পুলিশ... পুলিশ...

কথাটা মনে এল জল নিয়ে সাম্প্রতিক হট্টগোল নিয়ে। নীতি আয়োগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, খুব শিগগিরই ৪০টি বড় শহর জলশুণ্য হয়ে যাবে। তারপরই হট্টগোল শুরু হয়ে গেল, জলের অপচয় বন্ধ করুন। নানান ব্যঙ্গবিদ্রূপের আত্মঘাতী নমুনাও বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা সবাই-ই নাকি দায়ী এই সঙ্কটের জন্য। অতএব জলের রেশনিং চালু হোক, এমন শ্লোগান উঠল বলে। হুজুগে জনতাও সেই শ্লোগানে চটাপট হাততালি লাগাতে শুরু করে দেবেন, নিশ্চিত।

প্রশ্নটা হল, সাধারণ মানুষ ঠিক কতটা জলের অপচয় করতে পারেন? হ্যাঁ, সেটুকুও না হওয়াই উচিত। কিন্তু সমস্ত সাধারণ মানুষ যদি একসঙ্গে জলের অপচয় বন্ধ করেন, তাহলেও জল বাঁচবে কতখানি?

এটা অঙ্কের নিয়মে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তাহলেও একটা হিসাব কষা হয়েছে যে ভারতে ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ জলের মাত্র ৮-১০ শতাংশ লাগে গৃহস্থালির কাজে। যদি ধরেও নেওয়া যায়, এর অর্ধেকও অপচয় হয়, তাহলে আমরা সবাই মিলে ৪-৫% জল জমাতে পারব। বাকিটা? সেখানে কী হবে?

বোঝাই যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলের ৯০% অন্যত্র ব্যবহৃত হয়। একটা হল শিল্প, অন্যটা হল কৃষি। প্রথমে কৃষিতে আসা যাক। একটা দেশের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়েই বিশেষ বিশেষ ধরনের শষ্যের চাষের উদ্ভব হয়েছে। শেষ পঞ্চাশ বছরে প্রযুক্তির উন্নতির নামে চাষাবাদের ধরণটাই বদলে দেওয়া হয়েছে। ধরা যাক ধান। আমাদের প্রথাগত ধানচাষ ছিল দুই ধরণের, আমন আর আউশ। এর মধ্যে আমনটাই প্রধান।

আমন চাষ পুরোপুরি বৃষ্টিনির্ভর। ধানক্ষেতে জল জমবে, আর ধানগাছ লকলক করে বেড়ে উঠবে। বন্যা বা তুমুল বৃষ্টি হলে অবশ্য অন্য কথা। আবার আউশে জল লাগে খুব কম। কিন্তু বহুদিন ধরেই বোরো চাষ হয়ে উঠেছে প্রবল জনপ্রিয়। মূলত কৃত্রিম উচ্চ-ফলনশীল চারা এখানে ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিকভাবেই বোরো চাষে জল লাগে প্রচুর। যেখানে সেচের সুবিধা নেই, সেখানে মাটির তলার জল তুলেই সেই ঘাটতি মেটানো হয়।

আমরা কৃষকদের কাছে গিয়ে আবদার করতেই পারি, বোরো চাষ বন্ধ করে দিন। সামলাতে পারবেন তো? বোরো চাষ করে ভারতের সমস্ত কৃষক যা আয় করেন (লোকসানের প্রশ্নটা বিবেচনায় না রেখেই) তার অনেক বেশি উপার্জন করে বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির উৎপাদকরা। তারা ছেড়ে দেবেন? একটা একদমই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি।

নীলগঞ্জ চত্ত্বরে একটি ছেলে সম্পূর্ণ জৈব চাষের একটা প্রজেক্ট করেছিল। অন্তত পনের বছর আগে। যতদিন লাউ-কুমড়ো-পালংয়েই সীমাবদ্ধ ছিল, কেউ মাথা ঘামায়নি। উৎসাহে ছেলেটি তারপর পা বাড়াল ধানের দিকে। কিছুদিন পরেই অনেকেরই টনক নড়ল। প্রথমে লাগল জমির মালিকানা নিয়ে। 

অনেক দৌড়ঝাঁপ করে ছেলেটা সেগুলো সামলাল। ধানগাছ বেড়ে উঠছে। আশপাশের চাষীরা খোঁজখবর করতে আসছে। ধানের গায়ে প্রার্থিত রঙ ধরতে শুরু করেছে। অকস্মাৎ একদিন রাতে সমস্ত ধানগাছ গোড়া থেকে নিপুণ হাতে কাটা হয়ে গেল। থানা-পুলিশ করার হিম্মত আর ছেলেটার হয়নি। প্রজেক্ট থেকেই হাত তুলে নিয়েছিল।

যারা বাথরুমে বাড়তি জল খরচ করে, সঙ্গত কারণেই আমরা তাদের ব্যঙ্গ করি। তাহলে শুনে নিন, প্রতি লিটার শীতল পানীয় বানাতে ৮ লিটার জল লাগে। মানে ৭ লিটার জল পুরো বরবাদ। আর ভারতে শীতল পানীয় বানানোর সমস্ত কারখানাতেই ব্যবহার করা হয় ভূগর্ভস্থ জল। মানে একটা ছোট্ট দোকানে যদি ২০ লিটার কোক বা থামস আপ থাকে, তাহলে ১৪০ লিটার জল স্রেফ নেই হয়ে গেছে। এই অপচয়ের রাশ টানতে পারবেন? 

মাথায় রাখবেন কোক আর পেপসিকো মিলিয়ে এই দেশে ৫৮টি কারখানা আছে। আর হ্যাঁ, ভারতে ভূগর্ভস্থ জল তুলতে বাধা না থাকলেও খোদ মার্কিন মুলুকে কিন্তু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

কোথায় যাবেন? একটা সরল উপদেশ দেওয়া হয়, গাছ লাগান। আরে মশাই, একটা মহীরূহের প্রতিস্থাপন কয়েক হাজার টবের গাছ দিয়ে হয় না। 
বড় গাছ শুধু অক্সিজেনই দেয় না, লাগাতার বাষ্পমোচনের মাধ্যমে আকাশে মেঘ জমায়, বৃষ্টি আনে।

 আপনার গোটা বাড়ি বাহারি গুল্মে ঢেকে দিলেও তাদের সেই সাধ্য নেই। জানেন কি, গত কুড়ি বছরে ভারতের অরণ্য আর জলের উৎস বিকিয়ে গেছে বহুজাতিকের কাছে? 

বাইলাডিলার নাম শুনেছেন? না না, ট্রাভেল ম্যাগের আইটেম হিসাবে নয়; জঙ্গল রক্ষায় আদিবাসীদের মরণপণ লড়াইয়ের কেন্দ্রভূমি হিসাবে? পরিবেশ বাঁচাতে চান? শৌখিন টোটকা ছাড়ুন। তাদের কাছে শিখুন। 

প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্টকারী উন্নয়ন নামক বহুজাতিকের মুনাফা বৃদ্ধির উন্মত্ততার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তাহলেই কে দেড় ফোঁটা জল রাস্তায় ঢেলে দিল, সেটা নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না।



Post a Comment

0 Comments