সেই বইটি
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশকের দোকানে বসেছিলাম। সামনে কাউন্টারের ওপর নানা আকারের নানা রঙের বই। অসংখ্য মানুষের অসংখ্য মনের যেন এক বিশাল পৃথিবী এই বইগুলো। কত চিন্তা কত গবেষণা–জ্ঞান-বিজ্ঞানের কত খবর। সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসি, গল্পকবিতা, রোমান্স-অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্নপুরী।
অন্যমনস্কভাবে বইগুলো নাড়াচাড়া করছি, হঠাৎ একখানা বইয়ের ওপর এসে চোখ আটকে গেল আমার। মলাটে সেই পুরনো ছবিটি–সেই গাঢ় নীল বড় বড় হরফের লেখা, ‘গহন বনের গল্প’। লেখক প্রিয়দর্শন মিত্র।
আকাশে যেমন উল্কা ঝরে, তেমনিভাবে কতকগুলো বছর ঝরে গেছে। কত অদলবদল হয়েছে পৃথিবীর। আমরা যারা ছোট ছিলাম তারা বড় হয়ে গেছি–যাঁরা বড় ছিলেন, বুড়িয়ে গেছেন তাঁরা। ছেলেদের জন্যে হাজার হাজার রঙচঙে বইয়ে ছেয়ে গেছে বাজার। তাদের মাঝখান থেকে বহুদিনের চেনা বইখানা সেই চেনা চেহারা নিয়ে করুণ চোখে যেন আমার দিকে তাকাল।
প্রকাশককে বললাম, এ বইটার দাম কত?
একটু অবাক হলে প্রকাশক : কী করবেন ওবই নিয়ে? ছেলেদের বই পড়বার বাতিক আছে নাকি আপনার?
বললাম, তা আছে। আমারও যে একটা ছেলেবেলা ছিল, এসব বই দেখতে সে কথা মনে পড়ে যায়। এটা আমি নেব।
প্রকাশক তবু বললেন, নিতেই যদি হয়, তা হলে নতুন বই কিছু নিন বরং। ওসব তো পুরনো হয়ে গেছে। আজকালকার ছেলেরা আর পড়ে না।
–তা হোক। এইটেই আমার দরকার। কত দাম?
প্রকাশক বন্ধু লোক। হেসে বললেন, এমনিই নিয়ে যান। ওর আর দাম দিতে হবে না।
বাইরে এসে দাঁড়ালাম ট্রাম-স্টপের পাশে। দুপাশে বাড়িগুলোর মাথায় বেলাশেষের রাঙা আলো ঝিকমিক করছে–ছায়া ঘনিয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর। ঠাণ্ডা মিষ্টি হাওয়া বইছে। বইটাকে কাছে আঁকড়ে ধরে ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
নিজে বই লিখি এখন। সাহিত্যিক বন্ধুর অভাব নেই নতুন বই পাওয়ার দুঃখও নেই আর। তবু এই গহন বনের গল্প কোনওদিন এমনি করে হাতে আসবে, তা কল্পনাতেও ছিল না। মনে হত হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও যে-হীরেটা হারিয়ে ফেলেছিলাম একদিন, আজ অযাচিতভাবে তা আমার কাছে ফিরে এল। এখন এ আমার চিরদিনের মতোই আমার।
ট্রাম এল। চেপে বসে কন্ডাকটারকে বললাম, এসপ্ল্যানেড।
ট্রাম চলল। মনের মধ্যে ছেলেবলার দিনগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দিনাজপুরের শহর-ষষ্ঠীতলার বটগাছ কাঞ্চন নদীর ধারে, পুরনো সাহেবি গোরস্থানের পাশে পাশে সেই পথ। আম জাম বিলিতি পাকুড়ের ছায়া-লাটা গিলে আর বৈচির বন; সেই শঙ্খচিল, শেয়াল, গোসাপ আর গোখরোর খোলস। তার ভিতর দিয়ে চলেছি। ভিতরে কাঁপছে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা–দুরের আকাশে উড়ন্ত মস্ত গগনবেড় পাখিটার মতো কল্পনাও ডানা মেলেছে। এই পথটাও তো হয়ে যেতে পারে আফ্রিকার জঙ্গল,–এসে হাজির হতে পারে। গরিলা, সামনে লাফিয়ে পড়তে পারে সিংহবাইসনের সঙ্গে বাধতে পারে চিতাবাঘের। লড়াই–চারিদিক থরথর করে কেঁপে উঠতে পারে বুনো হাতির গর্জনে। ছেলেবেলার সেই ছুটির দিন–স্বপ্নভরা দুপুর বুকের ভিতর যেন ঝিমঝিম করে বাজতে লাগল।
চমক ভেঙে দেখি, গাড়ি এসপ্ল্যানেডে এসে ঢুকেছে। নেমে পড়লাম। কার্জন পার্কের পাশ কাটিয়ে, মনুমেন্ট ছাড়িয়ে, এগিয়ে গেলাম আরও খানিকটা। তারপর নিরিবিলি দেখে এক জায়গায় ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম।
বুকের কাছে বইটা এখনও ধরা। কোলের ওপর নামিয়ে রাখলাম। সন্ধ্যার আবছায়াতে গাঢ় সবুজ বড় বড় অক্ষরে লেখা গহন বনের গল্প ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু ছেলেবেলার হারানো দুপুরের রোদ লেগে ওই লেখাটাই ঝকঝক করে জ্বলতে লাগল বুকের ভিতরে।
সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। একেবারে পরিষ্কার ছবি দেখছি চোখে।
নিঝঝুম দুপুর। গরম হাওয়া বইছে। আমে রঙ ধরতে শুরু হয়েছে। মাঝখানে টার্মিনাল পরীক্ষা, তারপরেই গ্রীষ্মের ছুটি। ইস্কুলে আর মন বসতে চায় না। জানলা দিয়ে ঘন ঘন বাইরে তাকাই আর ভাবি-কখন লাস্ট পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়বে।
ড্রয়িং-এর ক্লাস নিচ্ছেন মৌলবী সাহেব। ভারি নিরীহ ভালোমানুষ। একটা ছোট্ট ঘোড়ার পিঠে জিনের বদলে একখানা কাঁথা বসিয়ে তাতেই চেপে ইস্কুলে আসতেন। আর ক্লাসে ঢুকে ব্ল্যাকবোর্ডে একটি ঘটি কিংবা বেগুন যা-হোক কিছু এঁকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তেন।
হেডমাস্টার কাছাকাছি না থাকলে ছেলেরা কেউ কেউ এই ফাঁকে তাঁর গোবেচারা ঘোড়াটায় চাপবার চেষ্টা করত। কেউ বা বেগুনের বদলে তাঁর মুখ আঁকত খাতায়। কোনওদিন ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে নিশ্চিন্তে ঘুমোতেন মৌলবী সাহেব। বেশি গোলমাল হলে কখনও কখনও ঘুম-ভরা চোখ তুলে আলগা ধমক দিয়ে বলতেন এই, এত গোলমাল হচ্ছে ক্যান? কানটা যে ফাটাই দিলে হে আমার!
এই মৌলবী সাহেবের ক্লাসেই–এমনি একটা মন-উড়ু দুপুরে এসে দেখা দিল গহন বনের গল্প।
যথারীতি একটা কুমড়ো এঁকে দিয়ে মৌলবী সাহেব ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি আর আমার পরম বন্ধু বাচ্চু সেন খাতায় কাটাকাটি খেলছি। এমন সময় চোখে পড়ল, সেকেন্ড বেঞ্চে বসে খগেন বড়াল খুব মন দিয়ে কী একখানা বই পড়ছে।
ব্যাপারটা একটু নতুন। ড্রয়িং ক্লাসের ছেলে খগেন, ভালো ছবির হাত। ওর আঁকা কুমড়োকে কখনও ঝিঙে বলে ভুল হয় না–মৌলবী সাহেব ওকে দশের মধ্যে এগারো নম্বর দিতে পারলে খুশি হন। এ-হেন খগেন ড্রয়িং ভুলে গিয়ে বই পড়ছে। কিমাশ্চর্যম!
কী বই রে ওটা খগেন?-কৌতূহল সামলাতে পারলাম না।
খগেন জবাব দিলে না। একেবারে তন্ময়।
-এই, বল না–কী বই?
খগেন ভারি বিরক্ত হল! রুদ্ধশ্বাসে বইয়ের একটা পাতা উলটে বললে, এখন ভীষণ ব্যাপার। রাত্তির বেলা সিংহ এসে শিকারিকে তাঁবু থেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে! গোলমাল করিসনি এখন!
শুনেই রোমাঞ্চ হল। থাবা দিয়ে বললাম, দে না একটু দেখি।
ঝট করে বইটা সরিয়ে নিল খগেন। চোখ পাকিয়ে বললে, খবরদার রঞ্জন মারামারি হয়ে যাবে বলছি!
মৌলবী সাহেবের ঘুম ভাঙল।
–হাঁ হে, তুমরা কি এইটাক খেলারু মাঠ পাইছ? বেশি গোলমাল হইলে সব হাফ ডাউন করাই দিব।
তখনকার মতো শান্তি রক্ষা হল কিন্তু কৌতূহলে মন ছটফট করতে লাগল। তারপর গোপীবাবুর অঙ্কের ক্লাস–যমের ঘণ্টা। ‘গহন বনের গল্প’ ধামাচাপা রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু ছুটি হতেই ফেউয়ের মতো লেগে গেলাম খগেনের পিছনে।
দে না ভাই, একটু দেখি বইটা।
খগেন বললে, আমার বই নয় পড়বার জন্যে চেয়ে এনেছি। আজই সন্ধেবেলা ফেরত দিতে হবে।
আমি তো আর নিচ্ছি না, হাতে করে দেখব শুধু। দে না একবার
খগেনের করুণা হল। বই-খাতার তলা থেকে সন্তর্পণে বইটা বের করে দিলে।
কিন্তু না দেখলেই ভালো হত। মোটা, বড় সাইজের বই–পাতায় পাতায় বুনো জানোয়ারের রোমাঞ্চকর ছবি। ছোট বড় অসংখ্য গল্প–কোনওটা মানুষখেকো সিংহ, কোনওটা গরিলার বিভীষিকা, কোনওটা কুমিরের করাল গ্রাস। পড়বার আগেই গা ছমছম করে ওঠে।
চমক ভাঙল খগেনের চিৎকারে।
বাঃ-দেখবার নাম করে বেশ পড়া শুরু হয়ে গেছে তো। ওসব চালাকি চলবে না, দাও বই। ছোঁ মেরে বইটা কেড়ে নিলে খগেন। বই তো নিলে না–যেন হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিলে! তারপরই আর কথা নেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলে বাড়ির দিকে।
আমি তবু সঙ্গ ছাড়ি না খগেনের।
-একদিনের জন্যে দিবি ভাই বইটা? একবেলার জন্যে?
বললাম তো, আমার বই নয়। আমাকে এড়াবার জন্যে খগেন আরও জোরে পা চালালে : অপরের কাছ থেকে এনেছি। সন্ধেবেলায় ফেরত দিতে হবে।
কার বই?
কালীতলার কুঞ্জর। হল তো? ইচ্ছে হয় তার কাছে থেকে চেয়ে নাও। বইটা পাছে আমি কেড়ে নিই, হয়তো এই ভয়েই খগেন একটা চলতি ঘোড়ার গাড়ির পিছনে উঠে বসল।
হতাশ চোখে আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিন্তু কালীতলার কুঞ্জ! মনটা ভয়ানক দমে গেল। কুঞ্জকে চিনি–বিলক্ষণ চিনি। গত দোলের সময়ও ওদের পাড়ার সঙ্গে আমাদের পাড়ার ছেলেদের বেশ একচোট মারামারি হয়ে গেছে-আমি নিজেই কয়েক ঘা বসিয়েছিলাম কুঞ্জকে। তা ছাড়া আমাদের সমবয়সী হলেও কুঞ্জ যে-পরিমাণে এঁচোড়ে পেকেছে তার তুলনা হয় না। ক্লাস ফাইভেই একবার ফেল করেছে-শুনেছি, সিগারেট খায়। সেই কুঞ্জর কাছে গিয়ে বই চাইতে হবে!
সম্ভব হলে নিজেই কিনতে পারতাম একখানা। কিন্তু বইয়ের দামটা দেখে নিয়েছি চোখের পলকে তিন টাকা! তিন টাকা। স্বপ্নের চেয়েও অসম্ভব! ইস্কুলের পয়সা বাঁচিয়ে আনা-ছয়েক সঞ্চয় করেছি নিজের কাছে। মার কাছে জমা আছে আট আনা। আরও আনা-আষ্টেক ছোড়দি দিলেও দিতে পারে– বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসেছে–মনটা খুশি আছে ছোড়দির। কিন্তু তিন টাকা। সে অনেক দূর, সেখানে পৌঁছুবার কোনও উপায় নেই।
একটা ভারি মন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
মা বললেন, মুখ অমন কেন রে? মার খেয়েছিস নাকি ইস্কুলে?
-না।
হাতমুখ ধুয়ে জলখাবারের দুধ-রুটি খেয়েই আবার বেরিয়ে পড়লাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে–ওরা ডাকল, আমি ফিরেও তাকালাম না। যেমন করে হোক, কুঞ্জকে আমার ধরা চাই-ই।
কুঞ্জকে পেতে অবশ্য দেরি হল না। স্টেশনের কাছে বাহাদুর বাজারের এক চায়ের দোকানে নিয়মিত বিকেলে আড্ডা দিতে দেখেছি ওকে। আজও সেইখানে ছিল সে। দুটো মস্ত মস্ত ধেড়ে ছেলের সঙ্গে হাত-পা ছুঁড়ে কী যেন আলোচনা করছিল।
বাবার কড়া হুকুম রাস্তার কোনও চায়ের দোকানে ঢোকা আমাদের বারণ। আরও বিশেষ করে এ-দোকানটা যত পাজি ছেলের আড্ডা। দোকানটার সামনে এসে আমার বুক কাঁপতে লাগল।
কিন্তু ‘গহন বনের গল্প’–পাতায় পাতায় তার ছবি, তার ‘গরিলার বিভীষিকা’ আর ‘মানুষখেকো সিংহ’ একটা অসহ্য তীব্র স্বরের মতো আমার মাথার মধ্যে কাঁপছে। আমি আর থাকতে পারলাম না।
দোকানে ঢুকে ডাকলাম কুঞ্জ!
কুঞ্জ প্রথমটা চমকে গেল। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুখ ভেংচে বললে, কী হে, গুড বয়, এখানে?
বললাম, তোর সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
কী কথা? আমার কাছে কী দরকার তোর–আমাদের ছায়া মাড়ালেও তো তোদের গুড কন্ডাক্টের প্রাইজ পাওয়া নষ্ট হয়ে যাবে! তেমনি ভ্যাংচানির ভঙ্গিতে কুঞ্জ হেসে উঠল।
-তোর বইটা একবার পড়তে দিবি আমাকে?–অপমানে কান জ্বালা করছিল, তবু না বলে থাকতে পারলাম না।
–আমার বই? কী বই?
‘গহন বনের গল্প।
–ও! খোঁজ পেয়েছ তা হলে! কুঞ্জর চোখ মিটমিট করতে লাগল: সে তো আমার কাছে নেই।
জানি। খগেন নিয়েছে। আজ সন্ধেবেলাতে ফেরত দেবে। আমি মিনতি করলাম; আজ রাত্রিটা আমায় পড়তে দে, কাল সকালেই তোকে দিয়ে যাব।
কুঞ্জ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর নাক কুঁচকে বললে, কেন দেব তোকে?
–ভাই কুঞ্জ
কুঞ্জ আবার ভেংচি কেটে বললে, অত ভাই-ভাই করতে হবে না! মারামারির সময় মনে থাকে না? আমাদের খারাপ ছেলে বলবার সময় মনে থাকে না?
এর পরে চায়ের দোকান থেকে সোজা বেরিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু পারলাম না। আমার ভেতরে তখনো জ্বরের মতো নেশাটা কাঁপছে! নিশির ডাকের মতো হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে।
বললাম, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। আজ থেকে আমরা বন্ধু।
–বন্ধু! কুঞ্জর চোখ আবার মিটমিট করতে লাগল : তাহলে প্রমাণ দেখা।
–কী প্রমাণ দেব?
–চা খাওয়া, চপ খাওয়া।
চা! চপ! চোখের সামনে অন্ধকার দেখলাম। বললাম, ভাই, পয়সা নেই।
–পয়সা নেই? কুঞ্জ আমার শার্টের পকেটটা নাড়া দিলে : ওই তো ঝনঝন্ করে উঠল। নেই মানে? ফাঁকি দিয়ে বন্ধুত্ব পাতিয়ে বই বাগাবার মতলব? সেটি হচ্ছে না চাঁদ।
–কিন্তু এ-পয়সা তো–আমি ঢোক গিললাম :ইনস্ট্রুমেন্ট বক্স কেনবার জন্য এনেছি।
কুঞ্জ খিঁচিয়ে উঠল : তবে তাই কেন গে না। মন দিয়ে লেখাপড় কর গে। গল্পের বই নিয়ে কী হবে? যা–পালা এখান থেকে।
পালাতে পারলে বাঁচতাম, কিন্তু কে যেন পা দুটো পাথর দিয়ে আটকে দিয়েছে আমার। বুকের মধ্যে যেন ঝড় বইছে! এত কষ্ট করেও পাব না বইটা? হাতের কাছে এসেও এমন করে ফসকে যাবে?
শুধু নেশা ধরাই নয়–আমার ঘাড়ে যেন ভূত চেপেছিল। না হলে, যে-দুঃসাহস আমি জীবনে ভাবতে পারিনিতাই করে ফেললাম। ফস করে বলে বসলাম, বেশ খা তুই চা-চপ।
খুশির হাসিতে কুঞ্জর চোখ ভরে উঠল। আমার পিঠে জোরে একটা থাবড়া বসিয়ে দিলে সে।
বাঃ, এই তো সত্যিকারের গুড বয়ের মতো কথা!–আমার হাত ধরে টেনে সে একটা লোহার চেয়ারে বসল। তারপর ডেকে বললে, বয়, দুখানা চপ আর দুটো চা।
সভয়ে বললাম, দোকানের চা তো আমি খাই না ভাই! চপও নয়।
–খাস না? তা বেশ। তাহলে দুটো চপই আমি খাই–কী বলিস? অদ্ভুত লোভে কুঞ্জর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল : কী বলিস-অ্যাঁ?
ইনস্ট্রুমেন্ট বক্সের পরিণামের কথা ভাবতে ভাবতে শুকনো গলায় আমি বললাম, খা।
প্লেটে করে দুখানা ধূমায়িত চপ এনে বয় সামনে রাখল। গন্ধে ভরে গেল চারিদিক।
কুঞ্জ খাবার আগেই খানিকটা লালা গিলে নিলে গলায়। থাবা দিয়ে একটা চপ গরম অবস্থাতেই তুলে নিয়ে কামড় বসাল। তারপর তৃপ্ত মুখে বললে, বেঁচে থাক রঞ্জু! গহন বনের গল্প তোর মারে কে? কিন্তু মাইরি বলছি, দৃষ্টি দিসনি মোদ্দা।
দৃষ্টি নয়-মুখ ফিরিয়ে বসে আমি ভাবতে লাগলাম ইনস্ট্রুমেন্ট বক্সের কথা। নিজের জমানো দু-আনা পয়সা দিয়ে বাকিটা পূরণ করা যাবে, তারপর ইস্কুলে যাওয়ার মুখে কিনে নিলেই হবে ওটা। কিন্তু বাড়ির কেউ যদি দেখতে পায়? যদি শুনতে পায় কেউ?
এখান থেকে তাড়াতাড়ি উঠতে পারলে বাঁচি এখন। কিন্তু উঠবার জো নেই–তারিয়ে-তারিয়ে শব্দ করে করে চপ খাচ্ছে কুঞ্জ। ওই শব্দটা যেন বুকের মধ্যে এসে বিঁধতে লাগল। ভয়ে কাঠ হয়ে আমি বসে রইলাম।
কতক্ষণ পরে কত যুগ পরে কুঞ্জর চা আর চপ খাওয়া শেষ হল জানি না। তারপর বললে, পাঁচ আনা পয়সা দে।
দিলাম।
বয়টাকে পয়সা দিয়ে কুঞ্জ একটা ঢেকুর তুলল।
–বেড়ে খাওয়ালি রঞ্জু। অনেকদিন মনে থাকবে। এবার একটা সিগারেট খাওয়া।–
সিগারেট!–আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল!
–হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, সিগারেট। আরও দুটো পয়সা ছাড়ো দেখি!
আবার পালাতে চাইলাম, কিন্তু পা দুটো যে পাথর দিয়ে বাঁধা। মন্ত্রমুগ্ধের মতোই দুটো পয়সা বের করে দিলাম। বয়টাকে দিয়ে কুঞ্জ সিগারেট আনাল। ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বললে, আঃ!
ততক্ষণে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেছে! প্রাণপণে উঠে দাঁড়ালাম।
সব তো হল ভাই। এবার বই?
কুঞ্জ খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বললে, নিস কাল সকালে।
কাল সকালে আবার কেন?–আমি প্রায় হাহাকার করে উঠলাম : বললি যে রাত্তিরেই!
কুঞ্জ বাধা দিয়ে বললে, এখন কে বাড়ি ফিরবে? আমার যেতে সেই ন-টা। সিনেমায় যাব কিনা? যা—যা–কাল সকালে আসিস আমাদের বাড়ি। বই নিয়ে যাবি, ইচ্ছে মতো রাখতে পারবি দু-তিন দিন।
–কিন্তু সকালে যে মাস্টারমশাই আসবেন!
–তার আমি কী করব? কুঞ্জ উঠে দাঁড়াল লম্বা একটা শিস টেনে বেরিয়ে এল চায়ের দোকান থেকে। পেছনে-পেছনে আমিও এলাম
–চল না ভাই একবার, পাঁচ মিনিটের জন্য! আমি মিনতি করলাম।
–কেন বিরক্ত করছিস? কুঞ্জ চলে গেল : বললাম না, সকালে আসিস? তারপরই সংক্ষেপে সব শেষ করে দিয়ে অন্য রাস্তায় পা চালিয়ে দিলে।
অস্বস্তি আর অপরাধ-বোধ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। অতটা না করলেও হত। একখানা বইয়ের জন্যে যে কাণ্ড করেছি, একবার তা জানাজানি হয়ে গেলে কী যে হবে, সে কথা ভাবতেও পারছি না।
তবু অপরাধের লজ্জা বেশিক্ষণ রইল না। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগল মোটা-মোটা সবুজ অক্ষরগুলো : গহন বনের গল্প। সারা রাত ধরে আফ্রিকার জঙ্গলের স্বপ্ন দেখলাম আমি। বইয়ের পাতায় চকিতের জন্য দেখা ছবিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠে আমার সমস্ত চেতনাকে আশ্চর্য অপরূপ অ্যাডভেঞ্চার দিয়ে ঘিরে রাখল!
ভোরের আলো ফোটবার আগেই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। তারপর জামাটা গায়ে চড়িয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলাম কালীতলার উদ্দেশে।
মা অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁরে, এত ভোরে কোথায় চললি এভাবে?
মায়ের কাছে কখনও মিথ্যা বলিনি। আজ প্রথম বলতে হল। একটু মর্নিং-ওয়াক করে আসি মা।
উত্তরে মা কী বললেন–সে কথা শোনবার সময় আমার ছিল না। আমি তখন দার্জিলিং মেলের মতো চলেছি কালীতলার দিকে। আমাদের বাড়ি থেকে কুঞ্জদের পাড়া প্রায় এক মাইল। মনে হচ্ছিল, যদি এক লাফে পৌঁছুতে পারতাম!
এখনি পাব! এখনি হাতে আসবে! কালকের সারা বিকেল, সারা সন্ধে, সারা রাত্রি যা নিয়ে স্বপ্নের ঘোরে কেটেছে–যার জন্যে চায়ের দোকানে ঢুকেছি, কুঞ্জকে সিগারেট খাইয়েছি মিথ্যা কথা বলেছি মায়ের কাছে–এখনই সেই মহাসম্পদ এসে যাবে আমার হাতের মুঠোয়। মনে হল, আমার পা চলছে না, হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছি আমি!
ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে চেঁচাতে লাগলাম : কুঞ্জ কুঞ্জ কুঞ্জ
ঘুম-ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এল কুঞ্জ। বিরক্তিভরা মুখে বললে, কি রে, কী হল? এই সাত-সকালে অমন চেঁচিয়ে মরছিস কেন?
–সেই বইটা?
–কোন বই কুঞ্জ যেন আকাশ থেকে পড়ল।
–সেই গহন বনের গল্প।
কুঞ্জ বললে, অ। তা, সে বই তো পাবি না!
–পাব না!–আমি যেন বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠলাম।
কুঞ্জ নিরাসক্ত স্বরে বললে, বই তো আমার নয়–আমার মামাতো বোন রত্নার। রত্না কাল রাতের ট্রেনে কলকাতায় ফিরে চলে গেছে, বইটাও নিয়ে গেছে।
আর এক মিনিট সামনে থাকলে আমি কুঞ্জর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম, আফ্রিকার সিংহের মতোই ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে ফেলতাম ওকে। তার আগেই ও বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে।
আবার বাড়ি ফিরলাম। এবার আর হাওয়ায় উড়ে নয়। চোখ ফেটে আবার কান্না আসছে–পা যে মাটির মধ্যে বসে যাচ্ছে। এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল কুঞ্জ! পুরনো শত্রুতার শোধ নিলে এমন করে!
যখন বাড়ি ফিরলাম তখন মাস্টারমশাই এসে বসে আছেন।
–এতক্ষণ কোথায় ছিলে রঞ্জু? শান্ত, গম্ভীর গলায় মাস্টারমশাই জানতে চাইলেন।
মর্নিং-ওয়াক করতে। বিবর্ণ মুখে জবাব দিলাম। পড়ার বই নামিয়ে আনলাম শেলফ থেকে।
কিছুক্ষণ আমার দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইলেন মাস্টারমশাই। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ইনস্ট্রুমেন্ট বক্স কোথায়?
আমার বুকটা ধক করে উঠল একবার। আস্তে আস্তে বললাম, কাল বিকেলে ভুলে গিয়েছিলাম। আজ কিনে আনব।
ভুলে গিয়েছিলে? মাস্টারমশাইয়ের চোখ আগুন হয়ে উঠল :কুঞ্জর সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা দিলে ভুলে যাওয়ারই কথা–কী বলো?
পরক্ষণেই একটি চড় এসে পড়ল আমার গালে। মাস্টারমশাই বজ্রের মতো গর্জে উঠলেন : চায়ের দোকানে ঢুকতে শিখছ। সিগারেট খেতে শিখছ? রাস্কেল বাঁদর
আর-একটা চড় এসে পড়ল গালে। মাথা ঘুরে গেল–একা তীব্র ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল পৃথিবীখানা।
চমক ভাঙল আমার। কুড়ি বছরের ওপার থেকে ফিরে এসেছি বর্তমানের মধ্যে। গড়ের মাঠে ঠাণ্ডা রাত নেমে এসেছে। কোলের ওপর গহন বনের গল্প একাকার হয়ে গেছে অন্ধকারে।
বইটাকে তেমনি বুকে চেপে ধরে আমি হাঁটতে লাগলাম।
এতদিন পরে ফিরে এসেছে। এ বই এখন আমার। যতবার খুশি পড়তে পারি, ইচ্ছে করলে মুখস্থ করতে পারি–পাড়ার সকলকে ডেকে-ডেকে পড়ে শোনাতে পারি। কিন্তু কিছুই করব না। আমার লাইব্রেরির পাঁচ হাজার বইয়ের ভিতর দিশিবিলিতি অজস্র বইয়ের মাঝখানে ওকে আমি লুকিয়ে রাখব। আমি এ বই পড়ব না। যদি আজ আর ভালো না লাগে! কুড়ি বছর আগেকার মনটা এর মধ্যে যদি বদলে গিয়ে থাকে– তা হলে? তা হলে?
0 Comments